শ্রী শ্রী বিদ্যা শিখা ॥ উপ-মহাদেশের এক
উজ্জল তারকা -স্বামী বিবেকানন্দ যাঁর জন্ম ১৮৬৩ সনে জানুয়ারী মাসের ১২ তারিখ সকাল ৬:৩৩।
তাঁর মাতার নাম ভূবনেশ্বরী আর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত। বিশ্বনাথ দত্ত কোলকাতা হাইকোর্টের
একজন প্রভাবশালী উকিল ছিলেন। মাতা ভূবনেশ্বরী শিব মন্দিরে শিবের নিকট একটি পুত্র সন্তান
প্রার্থনা করেছিলেন। ভূবনেশ্বরী মনে করতেন, তাঁর প্রার্থনার ফলেই পুত্রের জন্ম হয়েছে।
তাঁর ডাক নাম নরেন। ছোট বেলায় নরেন ছিলো দুরন্ত। তাকে সামাল দেয়া পিতা-মাতার পক্ষে
ছিলো কঠিন কাজ। তাঁর মা প্রায় সময় বলতেন, ‘শীব আমার নিকট
এক ভূত পাঠিয়ে দিয়েছে। এই ভূত নিয়ে আমি বিপদে আছি’।
নরেন প্রথমে বাড়ীতে তাঁর মায়ের নিকট লেখা
পড়া করেন। পরবর্তীতে পিতা বাড়ীতে গৃহ-শিক্ষক রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। নরেন Scottish
College (১৮৭১ ১৮৭৭ ) লেখাপড়া করেন। ১৮৮৪ সালে
রাজা রামমোহন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কোলকাতার Presidency
College থেকে স্মাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঐ বৎসর তাঁর পিতা মারা যান। পিতা মারা যাওয়ার
পর তাঁর বাড়ী অভাবের কালো ছায়া ঢেকে ফেলে। তাঁর আর পড়ালেখা হয়নি। নরেনের স্মরণ শক্তি
এতই তীব্র যে মাত্র ৬ বৎসর বয়সে সে রামায়ন মুখস্থ করে ফেলে। তিঁনি শুধু পড়ে যেতেন
-আর অমনি সকল কিছু মুথস্থ বলতে ও লিখতে পারতেন।
পিতার মৃত্যুর পর নরেন General
Assembly Institution এ শিক্ষকতার চাকুরী নিলেন। নরেন ছোট বেলা থেকেই ইশ্বর ভক্ত ছিলেন।
পিতার অজান্তে পিতার সংগী বয়স্ক মানুষদের গোপনে জিজ্ঞাস করতেন, তুমি কি ভগবান-কে দেখেছো
? একদিন এক মরমী সাধক, তাঁর পিতার ঘনিষ্ট বন্ধু প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর – নরেন তাঁকে
জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয়! ‘তুমি কি ভগবান-কে দেখেছো ’? উত্তরে প্রিন্স
দারকানাথ বললেন, ‘আমি দেখিনি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করি, তুঁমি একদিন ভগবান-কে দেখতে পাবে’। এমন কথা শুনে
নরেন দারুন খুশী। ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি নরেন ছিলো দারুন আত্বপ্রত্যয়ী
।
কলেজে লেখাপড়ার সময় Professsor Histon
এর নিকট থেকে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের নাম শুনতে পান। একজন আধ্যাতিক সাধকের হাত ধরে দাক্ষিণাশ্বরে
নরেন শ্রী রামকৃষ্ণের নিকট দেখা করতে যান। শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পেয়ে তিঁনি অভিভূত
হয়ে পড়েন। তিঁনি ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণের ভক্ত হওয়ার জন্য বাড়ী ছাড়েন, শ্রী রামকৃষ্ণও
তাঁকে ঘনিষ্ট ভক্ত হিসাবে গ্রহন করেন।
নরেন শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট থেকে জানতে পারেন,
‘প্রতিটি জীবে
ইশ্বর অবস্থান করছেন। কার সাথে তুমি দুর্বব্যবহার করছো?’ নরেনই লিখেছে, ‘বহুরুপে তোঁমাকে
ছাড়ি / কোথায় খুঁজেছি ইশ্বর ? জীবে প্রেম করে যেই জন/সেই জন সেবিছে ইশ্বর।’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ বলে ডাকতেন
এবং এই নামেই তিঁনি পৃথিবীর সকলের নিকট পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুবাস চন্দ্র
বসু, মাহাত্বা গান্ধী প্রমুখ মনীষিগণ স্বামীজি-কে ভীষণ পছন্দ করতেন। ১৮৮৬ সনে নরেন
আমেরিকার শিকাগো শহরে এক ধর্ম সভায় বক্তব্য রাখেন। ওই বক্তব্যই তাঁকে বিশ্বসভায় পরিচিত
করে তোলে। মাথায় পাগড়ি এবং শরীরে লাল কাপড় পরিহিত ধ্যানরত আসনে, তাঁর ছবিটি সারাবিশ্বেই
ব্যাপক পরিচিত। মেয়ে জাতির প্রতি নরেনের ছিলো ভীষণ শ্রদ্ধা। স্বামীজি বলতেন ধর্ম পরিবর্তনের
প্রয়োজন নাই। প্রতিটি ধর্মই পরিপূর্ণ। কোন সাম্প্রদায়িকতা নয়। শান্তিই ধর্ম এবং ইহার
নাম সত্য। অর্থাৎ সত্যই ধর্ম। পৃথিবীতে ধর্ম একটি এবং ইহা হলো সত্য । সত্য এক। একক
অবিচ্ছিন্ন। অবিনশ্বর। স্বামীজির ঐতিহাসিক একটি কুপের শিক্ষা পাঠকদের জন্য বর্ণনা করছি।
স্বামীজির একদল উচ্চ শ্রেণীর ভক্ত ছিলো।
একদিন তাঁদের উদ্দেশ্যে স্বামীজি একটি উদাহরন উপস্থাপন করেন। সেই উদাহারণটি ছিলো –
একদিন সমুদ্রের একটি ব্যাঙ ঘুরতে ঘুরতে একটি কুপে এসে উপস্থিত হলো। কুপের ভেতর একটি
ব্যাঙ ছিলো। সমুদ্রের ব্যাঙ ও কুপের ব্যাঙ এর দেখা হলো। সমুদ্রের ব্যাঙ কুপের ভেতর
প্রবেশ করে ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো।
কারণ, কুপ অত্যান্ত ছোট জায়গা। সমুদ্রের ব্যাঙ মনে করলো, সে-কুপের ব্যাঙকে শিক্ষিত
এবং আধুনিক করে গড়ে তুলবে এবং এই ধরণের কুপের
ভিতর যত ব্যাঙ আছে, তাদের সকলকে সমুদ্র সর্ম্পকে ধারণা দিবে এবং শিক্ষিত করে
উন্নত জীবনের জন্য সমুদ্রে নিয়ে যাবে।
সমুদ্রের ব্যাঙ কুয়ার ব্যাঙ-কে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এই কুপের
ভেতর কত দিন ধরে আছে ? কুপের ভিতরের ব্যাঙ
বললো, প্রায় সারাটি জীবন আমি কুপের ভিতরেই আছি এবং আমার খুব ভালো লাগছে। আনন্দেই আছি।
সমুদ্রের ব্যাঙ, কুপের ব্যাঙ এর নিকট ব্যাখ্যা
করলেন, দেখ ইহা হলো কুপ। অত্যন্ত ছোট জায়গা। এত ছোট জায়গা থাকা-খাওয়া, চলা-ফেরা এবং
জীবন যাত্রার মান অত্যান্ত দুর্বিষহ। তোমার এই কুপের চেয়ে আরো অনেক সুন্দর জায়গা এই
পৃথিবীতে আছে। এসবের মধ্যে আছে, যেমন পুকুর, বিল, নদী-নালা, বিশাল সমুদ্র কত কিছু
? তুমি সুন্দর সুন্দর এসব জায়গা দেখলে অবাক
হবে ও বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে পড়বে! কুপের ব্যাঙ উত্তরে বললো, ‘না আমার এইসব
সুন্দর জায়গার প্রয়োজন নাই। এই কুপের ভিতর আমি প্রায় জীবনব্যাপী আছি। ই্হাই আমার আনন্দ
– ভীষণ আনন্দ। এর চেয়ে আনন্দ পৃথিবীর কোথাও নাই। কুপের ভিতর আমি খুব সুখেই আছি। আামার
সুখ-শান্তি তোমার সহ্য হচ্ছে না। বুঝতে পারছি। তুমি আমার নিকট থেকে চলে যাও। অন্যান্য
কুপের ভিতর যে সকল ব্যাঙ বাস করছে, তুমি তাদের নিকটও যাবে না। তোমার বিল-খালে বা সমুদ্রে তুমি চলে যাও।
সমুদ্রের ব্যাঙ তার সকল বিদ্যা ও বুদ্ধি
প্রয়োগ করেও কুপের ঐ ব্যাঙ-কে খাল-বিল নদী-নালা এবং সমুদ্র সর্ম্পকে বুঝাতে ব্যর্থ
হলো। সমুদ্রের ব্যাঙ ব্যর্থ হয়ে এই কুপ থেকে বাহির হয়ে অন্য কুপে গিয়ে অন্য ব্যাঙ এর
নিকট একই বিষয় বর্ণণা করলো। অন্য কুপটির ব্যাঙ কিছুটা বুদ্ধিমান হওয়ায় সমুদ্রের ব্যাঙ-কে
বললো, ঠিক আছে। তুমি আমাকে পুকুরে নিয়ে চলো। দেখি, পুকুর কেমন? কুপের ব্যাঙ পুকুরে
গিয়ে পুকুরের বিশালতা দেখে কুপের ব্যাঙ আনন্দে লাফা-লাফি আরম্ভ করলো। সমুদ্রের ব্যাঙ
কুপের ব্যাঙকে আবারো বুঝালেন যে, এর চেয়েও সুন্দর জায়গা আছে, যেমন খাল-বিল, নদী-নালা
আরো কত কিছু? কুপের ব্যাঙ বললো, আমার আর নতুন জায়গার প্রয়োজন নাই। পুকুর হলো পৃথিবীতে
সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। আমি এর চেয়ে বেশী কিছু সুন্দর চাই না।
এবার সমুদ্রের ব্যাঙ এই কুপের ব্যাঙ এর
নিকট থেকে অন্য কুপের ব্যাঙ এর নিকট গিয়ে একই বিষয় বর্ণনা করলেন। এই বার এই কুপের ব্যাঙ
আরো কিছুটা বেশী বুদ্ধিমান। এই কুপের ব্যাঙটি পুকুর হয়ে খাল-বিল, নদী-নালায় পর্যন্ত
পৌঁছালো এবং বললো পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে বেশী সুন্দর জায়গা দেখেছে এবং ভালো জায়গায় আছে।
নির্বিগ্নে সাঁতার কাটতে পারছে। গোটা পৃথিবীই তাঁর। তাঁর চেয়ে সূখী জগতে আর কেহ নাই
।
সমুদ্রের ব্যাঙ বুঝতে পারলেন এর নিকট থেকে
আর ফল কিছু হবে না। তাই এবার সে অন্য কুপের ভিতর গিয়ে আরো বুদ্ধিমান ব্যাঙ খুঁজতে লাগলেন
এবং পেয়েও গেলেন। এই কুয়ার ভিতরের ব্যাঙ এর
নিকট সমুদ্রের ব্যাঙ সমুদ্র সর্ম্পকে বিশদ বর্ণনা পেশ করলেন। এরবার এই কুপের ব্যাঙ
পুকুর, বিল-খাল , নদী-নালা পার হয়ে বিশাল সমুদ্রে উপস্থিত হলেন। সমুদ্রে প্রচুর খাবার।
সীমাহীন জায়গা। চারদিকে সাঁতার কেটে কি আনন্দ! সে-যে এক বিশাল স্বর্গ। সে তার কুপের
ভেতর অন্যান্য ব্যাঙ এর সীমিত জায়গায় দুঃখময় জীবনের জন্য ব্যথিত হলো। কিন্তু করার কিছু
নাই। কুযার ব্যাঙগুলি যে, কথা শুনে না – কুয়ার ভিতর ব্যাঙগুলি কুয়ার ভিতর থেকে বাহির
হয়ে আসতে চায় না। কুয়ার ভিতরের ব্যাঙ এর নিকট
সমুদ্রের বিশালতা বর্ণনা করা ভীষণ কঠিন কাজ এবং সম্বব নয়। তাই হতাশ হয়ে সমুদ্রের ব্যাঙ
পূণরায় সমুদ্রে ফিরে গেলো।
আজকাল সমাজে আমরা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত,
কম-বেশী শিক্ষিত। বিভিন্ন পেশায় শিক্ষিত হয়ে
গর্বের সীমা নাই। প্রকৃতপক্ষে আমরাও একেক জন একেকটি নির্দিষ্ট কুপের ভিতর অবস্থান করছি।
একজন পন্ডিত ব্যক্তি মনে করছে – সে সবচেয়ে বড় পন্ডিত। তার চেয়ে বড় পন্ডিত আর কোথাও
নাই। একজন পি এইচডি ডিগ্রীধারী ভাবছে- তার চেয়ে বড় পিএইচ ডি ডিগ্রীধারী আর নাই। একজন
এস এস সি বা পিএইচডি ডিগ্রীধারী আছেন, যে মানুষকে সালাম দিতে রাজী নন। ৮০ বছরের একজন
জন বৃদ্ধ, একজন পিএইডি ডিগ্রীধারীকে সালাম না দিলে, উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ে!!!
একজন পুলিশ কনষ্টেবল একজন নিরীহ পথচারীকে
ঠাস করে চাপার মধ্যে চড় থাপ্পড় মারছে। কাধে সরকারী রাইফেল। হাতে লাঠি। বাহ কি ক্ষমতা!
কাধে সরকারী রাইফেল পেয়ে তার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক/শিক্ষার্থী ও মানুষের
কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। শহরে গরীব ভ্যানওয়ালা বা রিকশা চালক কথা মতো কাজ না করলে,
আবাল-বৃদ্ধ যাই হোক, লাঠি দিয়ে আঘাত করে হাত ভেংগে দিচ্ছে। ভয়াবহ শক্তিধর ! এভাবে চলছে,
একক কুয়ার ভিতরে অবস্থানরত একেক পন্ডিত ও শক্তিধরের তান্ডব রাজত্ব বা লীলা।
অথবা একজন হুজুর যিনি ব্যবসা করেন- আর
পণ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশ্রিত করেন- সে মনে করে, তার চেয়ে ভালো মানুষ জগতে আর নাই। কারণ,
সে নামাজ পড়ছে/ আল্লাহ্-কে ডাকছে। ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের সেবা করছে। তার এক কথা-
নামাজের কাজ নামাজ করবে, ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের/সমাজের সেবা করা হচ্ছে। তার মতো সেবক
সমাজে আর কেহ নাই।
পণ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশ্রিত করার ফলে মানুষ
অসুস্থ হচ্ছে – ইহা কোন বিষয় নয়। নামাজ চলছে – মিথ্যা কথাও চলছে ট্রেনের গতিতে। খাদ্যদ্রব্যে
ভেজাল মিশানোর ফলে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে – সে কোন বিষয় নয়। নামাজের মাধ্যমে একদিন সে
বেহেশতে যাবেই। এই অদ্ভুত ও অলীক চিন্তায়
– সে বিভোর। সে ভাবছে – সে পিএইডি ডিগ্রীধারীর
চেয়ে উপরে অবস্থান করছে। কারণ -সে পাঁচ ওয়াক্ত
নামাজে পড়ছে। আল্লাহ্-কে ডাকছে। তার চেয়ে মহান আর কে? সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ডাকে, সে
আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করে। আখেরী মোনাজাতে হাজার হাজার মানুষ আমিন ! আমিন ! অথবা
গর্দভের মতো ঠিক! ঠিক! বলছে। ফল হউক আর নাইবা
হোক। সে-যে জগত বিখ্যাত পন্ডিত।
চার পাশে গরীব অসহায়, অসুস্থ ও পীড়িত মানুষের
আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠলেও নামাজী কিংবা পিএইডি ডিগ্রীধারীর ভ্রক্ষেপ নাই। তার নিজ
নিজ জায়গায় নিজের রাজত্ব ও মহানতায় নিয়ে ব্যস্ত। এভাবেই এককজন একেক বিশেষ ধরনের পন্ডিত
ও নিজ নিজ কুপের ভিতর বাস করছে। কোন পন্ডিত নিজের রাজত্বেও বাইরে কিছু শুনতে রাজী নয়।
আমরা বিভিন শ্রেণী পেশায় কাজ করি। বাজার
করি- ভালোমন্দ খাই। চলি-ফিরি। একদিন অজান্তে এবং অনিচ্ছায় জোরপূর্বক মৃত্যুর কোলে ঢলে
পড়ি অথবা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ি। অর্থৎ মৃত্যু যেন আমাদের নিকট না আসতে
পারে- সেই বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি। ধানমন্ডি বা গুলশানে ৭/৮ তলা বিল্ডিং। কত সম্পদ?
এইগুলি রেখে কি মৃত্যু বরণ করা যায়? তারপরও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ি এবং মৃত্যুর নিকট
পরাজিত হই। মৃত্যু গোটা পৃথিবীতে তাঁর কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরাও কম কি ? আমরা মৃত্যুর
সাথে পাঞ্জা লড়ছি। তবু গুলশানের ৭তলা বিল্ডিংটি নতুনের জন্য ছাড়তে রাজী নই। শেষ পর্যন্ত
জীবনের সমাপ্তি ঘটছে মনে করি। শ্রেণী পেশার কুপের জীবনে ইহাই স্বাভাবিক।
তাই জীবনে নিশ্চিতে সত্য পথ ধরে একাই চলতে
হবে। কেহ মনে চাইলে আসবে নতুবা আসবে না। ইহাই সত্য প্রচার এবং সত্য অনুসন্ধান। সত্য
প্রচারক এবং সত্য অনুসন্ধানীর সংখ্যা সর্বকালেই নিতান্তই খুব সামান্য। আশা যে, একদিন
মানুষ নিজ নিজ কুয়ার ভিতর থেকে নিজ দায়িত্বে উঠে আসবে এবং বিশাল সমুদ্রের সন্ধানে নিজেকে
নিয়োজিত করবে। স্বামীজির আবির্ভাব দিবসে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
‘এসব
দেখি কানার হাটবাজার বেদবিধির পর শাস্ত্রকানা
আর এক কানা মন
আমার।’ উক্তপদে
‘কানার’ স্বরূপ দারুণ অলঙ্করণে ও প্রহসনের মাধ্যমে
সাঁইজি তুলে ধরেছেন। মোটাদাগে দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে আমরা কানা বলে থাকি। তবে এখানে ‘কানা’ অর্থে সামগ্রিক দর্শন ঘাটতির কথা উঠে এসেছে। ‘কানা’ শব্দটি কন্ ধাতুসাধিত। এর অর্থ নিমীলন
অর্থাৎ চোখবন্ধকরণ। দুটো আঙ্গিক চোখের বাইরেও একটি আত্মিক চোখ বিদ্যমান যাকে ত্রিনয়ন (third eye) বলে। এই নয়ন নষ্ট
হলে ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টিতে আবরণ পড়ে যায় যার ফলে তার আচরণে শঠতা, ছল, মুগ্ধতা প্রকাশ পায়। সংসারে এই অস্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন
জীবের রমরমা অবস্থাকে সাঁইজি বলছেন‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’। মনোদৈহিক
অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য যা ধারণ করা
হয় তার নাম ধর্ম; এই সত্য জেনে
তা সম্পাদিত হলে সেটাকে বলে ধর্মজ্ঞানসাধন যাকে অন্যকথায় ‘বেদ’ও বলে। বৈদিক
আচার শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ পরম্পরায় যে অনুশাসন লাভ
করে তার নাম শাস্ত্র। সার্বিক অর্থে বেদ-স্মৃতি-শ্রুতি-পুরাণ সবটাই শাস্ত্রবাচ্য। শাসনকে যা ত্রাণ (উদ্ধার)
করে তাকে শাস্ত্র বলা হয়। যিনি শাসনের অধীন তিনি শিষ্য। আসলে এই শাসানি স্বেচ্ছাচারী
ইন্দ্রিয়াচার দমনের জন্য। মোহাবিষ্ট মন ঘোরের মধ্যে
থেকে বিশেষ চোখ বা বিচক্ষণতা হারিয়ে
ফেলে তখন অনুশাসনীয় কর্মকা- (বেদবিধি, শাস্ত্র) সেই অন্ধচোখ দেখতে পায় না। এটাকে সাঁইজি ‘বেদবিধির পর শাস্ত্র কানা/আর এক কানা
মন আমার’ বলে নির্দিষ্ট করেছেন। ‘পন্ডিত কানা অহঙ্কারে গ্রামের
মাতবর কানা চোগলখোরে সাধু কানা অনবিচারে আন্দাজি
এক ঘুঁটি গাড়ে জানে
না সীমানা তার।’ প্রত্যেকের
অহম (আমি) যা করে তা-ই অহঙ্কার। পন্ডিতের
মধ্যে প- আছে, যা
কমবেশি কৃতকার্যকে (নষ্ট)
করে দেয় এ কারণে যে,
পন্ডিতসুলভ বুদ্ধিতে সব কাজের কর্তা
হয় পন্ডিত আমি; আদতে যার কর্তা পরম আমি। মিথ্যে আমি তার দৃষ্টিকে একচোখা করে দেয় এটাই পন্ডিতের অহঙ্কার। মাতবর নিজেকে গ্রামজনপদের প্রধান ভেবে তাকে উৎকর্ষে উন্নীত করে অন্যসবাইকে অবজ্ঞা করে। এই আত্মাভিমানে আড়ালে
সে অন্যের কুৎসা গায়। হীনমানসিকতা তার জ্ঞানচক্ষুকে ছিদ্র করে দেয়। এটাই গ্রামপ্রধানের অবজ্ঞাজনিত অন্ধত্ব যেটা লালন গায়নে‘গ্রামের মাতবর কানা চোগলখোরে।’ সাধনমার্গের পথিকের বিচরণ ও আচরণে সুষ্ঠ
বাছাই না থাকলে সে
বিচারদোষে দুষ্ট হয় যা ‘সাধু
কানা অনবিচারে’ বলে বর্ণিত। পন্ডিত-মাতবর-সাধু মহলের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন না ঘটায় প্রমাণে
পৌঁছুতে না পেরে নিতান্ত
অনুমানে সীমিত গন্ডির মধ্যে তারা চলাচল করে যাকে লালন বলছেন ‘আন্দাজি এক ঘুঁটি গাড়ে
জানে না সীমানা তার।’
‘এক কানা কয় আর এক
কানারে চল
সাধুর বাজারে নিজে কানা পথ চেনে না পরকে
ডাকে বারংবার।’ মোহনিদ্রায়
আচ্ছন্ন একজন মোহাবিষ্ট অন্যজনকে মোহমুক্তির বার্তা প্রচার করে। কামিনীকাঞ্চনাসক্ত মন আরেক কামুককে
পদস্থ করতে গিয়ে সংসারকার্য সম্পাদনের ঠিকানা নির্ণয় করে দেয়; লালন সংকীর্তনে যার ধুয়া ‘এক কানা কয়
আর এক কানারে/চল
সাধুর বাজারে।’ পরিতাপের বিষয় সাধনমার্গের হদিস না জানা সত্ত্বেও
অর্থাৎ দিশাপ্রাপ্ত না হয়ে অনাদিষ্টরা
অন্যকে বারবার আদেশ-উপদেশ দিতে থাকে। ‘কানায় কানায় ওলামেলা বোবাতে
খায় রসগোল্লা লালন তেমনই মদনভোলা ঘুমের
ঘোরে দেয় বাহার।’ অজ্ঞতার
(কানা) অধিকারী (ওয়ালা)-দের সমাবেশকে (মেলা) বলা হয়েছে কানায় কানায় ওলামেলা। আস্বাদনীয় বস্তুকে অন্ধজন ভোগ করে একান্ত ঘোরে যা ‘বোবাতে খায় রসগোল্লা’র সমার্থক। লালন
সাধারণের কাতারে শামিল হয়ে মদগর্বে আপনাকে ভুলে অন্ধকার গৃহ শোভিত করতে চাইছে যা সাঁইজির খবরে
‘লালন তেমনই মদনভোলা/ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার’ রূপে প্রচারিত।(চলবে)
দিলশাদ
সুলতানা অন্তরা ॥ শরীরটা ক’দিন যাবত অন্যরকম লাগত। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে
থাকতো। থেকে থেকে বুক ধরফর করতো। নাটক সিনেমার মত বমি হওয়া,
টক খাওয়া দিয়ে আমার নতুন প্রাণের আগমণ বার্তা আসেনি। এসেছিল অন্যরকম অনুভূতি দিয়ে। টেস্ট করে যখন প্রেগনেন্সির খবর নিশ্চিত করি, বাবার বাড়ি শ্বশুরবাড়ি
মিলিয়ে তখন উৎসব আমেজ। অদ্ভূত এক মিশ্র অনুভূতি।
আনন্দ, উৎসাহ, উচ্ছাস, ভয়, বিস্ময়, সব মিলিয়ে কি
একটা জগা খিচুড়ি। মালিকের কৃপায় পুরো সময়টাই মোটামুটি সুস্থ স্বাভাবিক কেটেছে। পুরো গর্ভকালীন সময়টাই আমি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবার উপর নির্ভরশীল ছিলাম। আমাদের দেশে পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্যরা গর্ভবতী মায়ের ভালো মন্দ দেখাশোনার গুরুদায়িত্ব পালন করে। প্রবাসে নিজেই নিজের অভিভাবক। এখানকার মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমার জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা ছিল।
শুরুতেই বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা মেডিকেল রেকর্ড, পারিবারিক অসুস্থতার ইতিহাস সবকিছু বিবেচনা করে হাই অথবা লো রিস্ক প্রেগনেন্সি
ধরা হয়। জটিলতা না থাকলে গর্ভবতী
মায়ের নিয়মিত চেকআপের দায়িত্ব থাকে মিডওয়াইফ বা ধাত্রীর উপর।
এই ধাত্রী আমাদের দেশের গ্রামীণ ধাত্রী নয়, যারা বংশ পরম্পরায় সন্তান প্রসবে সহায়তা করে। ইউকেতে এমন সাহায্যকারীদেরকে ডুলা (doula) বলা হয়। মিডওয়াইফ হওয়া এখানে যথেষ্ট সম্মানজনক পেশা। এবং যথাযথ কোর্স (Midwifery) আর প্রশিক্ষণের পরই
একজন স্বীকৃত মিডওয়াইফ হিসেবে কাজ করতে পারে। অপরদিকে হাই রিস্ক প্রেগনেন্সিতেও মিডওয়াইফ চেকআপ করে, তবে জটিলতা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও ফলোআপ করে। গর্ভাবস্থায় ১৪ সপ্তাহ ও
২০ সপ্তাহ আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। এর আগে বা
পরে কোনরকম জটিলতা দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে আলট্রাসনোগ্রাম করে নিয়মিত রক্ত ও প্রসাব পরীক্ষা
করে। শুরু থেকে মাল্টিভিটামিন ছাড়া যে কোনও ওষুধ
দেয়া থেকে এখানকার ডাক্তার বিরত থাকে। খুব প্রয়োজন না হলে প্যারাসিট্যামল
ছাড়া অন্য ওষুধ এড়িয়ে চলে। বমির সমস্যার জন্য প্রথম কয় মাস আমি
খাওয়া দাওয়া
করতে পারতাম না। অনেক অনুনয় বিনয় করেও সমবেদনা ছাড়া কিছু জোটেনি। এদিকে আমাদের দেশে আমার চেনা জানার মধ্যে সম-সাময়িক যারা
সন্তান সম্ভবা ছিল, সবারই দেখি একদম শুরু থেকে বমির ওষুধ, রুচির ওষুধ, হজমের ওষুধ, বেডরেষ্ট, কত রকম নির্দেশনা
গাইনোকলজিস্টের। আর এখানে বেড
রেস্ট তো দূরে থাক,
সাঁতার সাইকেলিং, টেনিস খেলা, ব্যায়াম সবকিছুতে উৎসাহ দেয়। বমির সমস্যা হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর থেকে কিটোন (keton) নামক উপাদান নি:সৃত না
হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘরোয়া টোটকা / নিরাময়ই ভরসা। আমরা জানি আমাদের শরীর গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদন করে। শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে গেলে পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদনের জন্যই ক্ষতিকর। বতর্মান সময়ে কিটো ডায়েট খুবই জনপ্রিয়। তবে জনপ্রিয় হলেও এর অপকারিতা সম্পর্কেও
এখন প্রচুর লেখালেখি হয়।
মূল
কথায় আসি, দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় আমার অতিরিক্ত বমির কারণে কিটোসিস প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তখন
জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করে গ্লুকোজ ও বমির ওষুধ
চালু করে। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলত পারি যে প্রাকৃতিক নিয়মে
ব্যঘাত ঘটায় এমন যে কোন পদক্ষেপ
নিতেই পশ্চিমা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নারাজ। অগত্যা স্বাভাবিক নিয়মেই সবকিছু চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলে। আমাদের দেশে সন্তানের আগমনী বার্তা পাবার সাথে সাথেই ধরে নেয়া যায় ডেলিভারি সিজারে মাধ্যমে হবে। এই সিজার যে
কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ ও মায়ের শরীরে
এর প্রভাব কতখানি তা বুঝতে বুঝতেই
দুইবার অন্তত সিজার করা হয়ে যায়। পত্র-পত্রিকায় সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায় যা বোঝা যায়
তা হল ডাক্তার ও
হাসপাতাল টাকার লোভে সন্তান সম্ভবা মা ও তার
পরিবারকে নানান রকম ঝুঁকির ভয় দেখিয়ে সিজার
করাতে বাধ্য করে। গর্ভের সন্তান বেশি বড় হয় যাচ্ছে
নয়ত ওজন কম, নয়ত পানি কমে যাচ্ছে, ইত্যাদি কারণ দর্শিয়ে সিজার করে থাকে। অবশ্যই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিজার করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। যেমন আমার নিজেরও দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম সিজারের মাধ্যমে। তবে আমাদের দেশে মাত্রাতিরিক্ত সিজারের জন্য সাধারণ জনগণ দায়ী করে ডাক্তারকে। আর ডাক্তাররা দায়ী
করেন রোগীদেরকে। পুরো বিষয়টি নিয়েই রয়েছে নানান মত বিরোধ। আশে-পাশের বিভিন্ন শুভাকাঙ্খীদের উপদেশ, পরামর্শ ও নানান কুসংস্কারের
পালন সব মিলিয়ে গর্ভবতী
মায়ের অবস্থা এমনিতেই কাহিল হয়ে যায়। দু:খের বিষয়
এই যে এ ব্যাপারে
কথা উঠলেই পশ্চিমা বিশ্ব কতটা উন্নত আর আমাদের দেশ
কতখানি পেছানো সেই তর্কের ঝড় ওঠে। আমাদের
সোনার দেশের সোনার সন্তানেরা ভুমিষ্ঠ হবার আগেই কেন এত জটিলতার সম্মুখীন
হচ্ছে জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে খোঁজ নিতে শুরু করি। অবাক হয়ে জানতে পারি আমাদের দেশে ২০১০ সালে মিডওয়াইফরি কোর্স ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা
চালু করা হয়। কিন্তু জনসচেতনতার অভাব, যথাযথ অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেবায় অব্যবস্থা সব মিলিয়ে এই
গোটা দিকটাই অন্ধকারে অবস্থান করছে। এরপর কথা বলা শুরু করি পরিচিত যারা কাছাকাছি সময়ে মা হয়েছেন বা
হবেন তাদের সাথে। অধিকাংশের অভিযোগ আমাদের দেশের গাইনী বিশেষজ্ঞের কথা-বার্তায়ই সহমর্মীতা ও নম্রতার অভাব।
একজন সন্তান সম্ভবা এমনিতেই হাজার রকমের দুশ্চিন্তা, শারীরিক পরিবর্তন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত
থাকে। সেখানে ডাক্তারের সামান্য সহানুভূতি ও সহমর্মীতার দু’একটি কথা কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তা হয়ত তারা
উপলব্ধি করেন না, কিন্তু আমার মতে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখলে জানতে পারবেন যে একজন আন্তরিক
সহানুভূতিশীল চিকিৎসকের সাথে দেখা করেই উপসর্গ অনেকখানি কমে যায়। বছরের পর বছর পার
হয়ে গেলেও রোগীর মুখে মুখে সেই চিকিৎসকের নাম ও প্রশংসা শুনতে
পাওয়া যায়। যখন
কোন কারণে মুষড়ে পড়েছি, ডেলিভারির সময় যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি এমনকি নিয়মিত চেকআপের সময়ও আমার মিডওয়াইফ, ডাক্তাররা বার বার বলেছে ‘ইউ আর ডুইং
গ্রেট মামি, ইউ আর সো
ব্রেভ’; এই ধরনের কথা
শুধু আমাকে না, যে কোন অন্ত:স্বত্তা বা নতুন মাকেই
তারা বলে থাকে। অপ্রয়োজনীয় অতি সাধারণ এই কথাগুলো যাকে
উদ্দেশ্য করে বলা হয় তার ভেতরে
যে পরিমাণ ভরসার সঞ্চার করে তা অতুলনীয়। মাতৃত্ব
মানেই এক রাশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পূর্ণ অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা। মা যতই চেষ্টা
করুক,
যতই
ভালোভাবে নিজের সন্তানের যত্ম নিক, ভেতরে অজানা আশংকা অসন্তুষ্টি থেকেই যায়। একজন মা যখন নিজের
ভেতরেই হাজার খানেক ভুল ত্রুটির হিসাব কষতে শুরু করে, সন্তানের কোন অসুখ অস্বস্থি, বা গর্ভকালীন জটিলতার
জন্য নিজেকে দায়ী করে, আশ্বাসের সেই দুই চারটা বাক্য সেখানে ভালো বৈ খারাপ কিছু
করে না। এবার আসি মাতৃত্বের এই আদিম অথচ
আশ্চর্যজনক এই যাত্রায় সন্তানের
বাবার ভূমিকায়। গর্ভাবস্থায় ২৮ সপ্তাহ পার
হবার পর ইউকে তে
জন্মপূর্ববর্তী ক্লাস বা অ্যানটেনাটাল
ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। ১০-১২ জন
অন্ত:স্বত্তাকে নিয়ে একটি গ্রুপ হয় এবং তাদের সাথে
একজন করে বার্থ পার্টনার, যিনি সন্তান জন্মের সময় সাথে থাকবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বার্থ পার্টনার সন্তানের বাবা বা নানী/দাদী
হয়ে থাকে। অ্যান্টিনেটাল ক্লাসের উদ্দেশ্যই হলো নতুন মা বাবাকে সন্তান
জন্মের সময়ের জন্য যথাসম্ভব প্রস্তুত করা। নরমাল ডেলিভারির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। হাসপাতালের ব্যাগ গোছানো, প্রয়োজনীয় কি কি জিনিস
ব্যাগে রাখতে হবে, কোন কোন উপসর্গ দেখলে বুঝতে হবে প্রসব বেদনার শুরু হয়েছে, ব্যাথা শুরু হয়ে গেলে শিশুর জন্মের আগ পর্যন্ত কি
কি সুযোগ – সুবিধা ও ব্যথা নিরাময়ের
উপায় এভেইলেবল আছে তার ধারণাও এই ক্লাসগুলোতে দিয়ে
দেয়। বার্থ পার্টনার এর করণীয় কি
কি আছে সেই প্রস্তুতিও সেখান থেকে শুরু হয়। নতুন মা ও বাবার
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য অ্যাটেনাটাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতকের পরিচর্চা ও পরিচর্যা, দুধ
খাওয়ানো, নতুন মায়ের জন্য স্বাভাবিক অস্বাভাবিক সম্ভাব্য সব পরিস্থিতি নিয়ে
কাঠামোভিত্তিক একটি শর্ট কোর্সের মত এটি। বিনা
মূল্যে এলাকাভিত্তিকভাবে এই ক্লাসের ব্যবস্থা
করা হয়। এমনই এক ক্লাসে আমাদের
প্রশিক্ষক একদিন সব বার্থ পার্টনারদের
জন্য লাইফ জ্যাকেটের মত ভারী ভারী
জ্যাকেট নিয়ে আসে। গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের অনাগত সন্তানের ওজন বয়ে সাধারণ চলাফেরা, কাজকর্ম করা কতটা কষ্টকর, তার নমুনা দেখানোর জন্যই এই আয়োজন করা
হয়। প্রত্যেক বার্থ পার্টনার কে এই জ্যাকেট
পরে হাঁটা চলা, মেঝে থেকে জিনিস তোলা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজ করতে বলা হয়। স্বভাবতই কিছুক্ষণের মধ্যে তারা হাপিয়ে যায় এবং তারপর কোমর ব্যাথার কারণে খুলে ফেলে। এছাড়াও নবজাতকে নিয়ে প্রথম দিনগুলো কেমন কাটতে পারে, কিভাবে আরেকটু সহজ করা যেতে পারে এই সময়টাকে, তা
বিভিন্ন ধরনের ভিডিও এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে ধারণা দিয়ে দেয়। সন্তান জন্মের সময় বাবার উপস্থিতি ও সন্তান লালন
পালনে বাবার সক্রিয় ভূমিকায় এখানে শুরু থেকে উৎসাহ দেয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে সন্তান জন্মের সময় তো দূরে থাক,
সাধারণ স্ক্যানের সময়ও বেশিরবাগ সময়ে বাবাকে থাকতে দেয়া হয় না। বর্তমানে
অনেক বাবা শিশুর পরিচর্চায় অংশগ্রহণ করলেও অনেক পরিবারের সদস্যদের বিরূপ মন্তব্য, কখনো নিরুৎসাহে পিছিয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক প্রয়োজনে নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উপার্জন করলেও সন্তানের দেখাশুনা নারীকেন্দ্রিক কাজ কেন হবে, এই প্রসঙ্গে আলোচনা
সমালোচনার শেষ নেই। একই ঘরে নারী পুরুষ উভয়ে থাকলেও সেই ঘরের ঝাড়া, মোছা রান্নাবান্না ইত্যাদি কাজে অংশগ্রহণ করতে বাড়ির ছেলেদের পৌরুষে কেন আঘাত আসে, তার উত্তর আমাদের সমাজ দিতে পারে না। যেই সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে বাবায়-মা দুজনেরই জৈবিক
ভূমিকা সমান, সেই সন্তানের লালন পালনের ভার শুধু মায়ের উপর এসে পড়ে। আর বাবার দিন
শেষে শিশুকে নেড়েচেড়ে একটু খেলেই জগত সংসারকে ধন্য করেন।সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর একজন মায়ের
শরীরে শুধু হরমোনের পরিবর্তন হয় না। নতুন স্বত্তাকে জায়গা দেবার জন্য মায়ের আভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কুঁচকে সরে যেতে থাকে। মেরুদন্ড দেহের ভার সামলানোর জন্য বেঁকে যায়। শরীরে যে কোন নতুন
– অপরিচত অস্তিত্বকে ক্ষতিকর হিসেবে ধরে আমাদের শরীর। ফলস্বরূপ দেহে অ্যান্ডিবডি তৈরি হয়। বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীর এভাবেই মোকাবেলা করে। নতুন ভ্রুণকে মায়ের শরীর যেন প্রত্যাখ্যান না করে তার
জন্য গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে সবচেয়ে দুর্বল।
শরীরে
অতিরিক্ত অক্সিজেনের যোগান দিতে মায়ের মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। যার কারণে গর্ভাবস্থায় অনেক নারীদের অভিযোগ থাকে যে তারা অনেক
কিছু ভুলে যায়, দাপ্তরিক কাজে সময় লাগে, হিসাব
নিকাশে ভুল ত্রুটি হয়। অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এই অবস্থাকে প্রেগনেন্সি
ব্রেইন বলা হয়। হরমোনজনিত উপসর্গগুলো শুধু মায়ের শরীরে নয়, মানসিক সুস্থতারও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য মাতৃত্বকালীন মানসিক পরিবর্তনকে ইউকেতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখে। প্রতিবার চেক আপের সময় তারা জানতে চায় আমি মানসিকভাবে কেমন বোধ করি। অবসাদ, অস্থিরতা, বিষন্নতার ক্ষেত্রে তারা তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নেয়। সমাজসেবিরা বাড়িতে গিয়ে গিয়ে গর্ভবতী বা নতুন মায়ের
সাথে সময় কাটায়, কথা বলে, প্রয়োজনে তাকে অন্যান্য সেবা প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত করে। এলাকাভিত্তিক কমিউিনিটি সেন্টারগুলো নানান ধরনের সেবার সুব্যবস্থা করে। অথচ অবাক হয়ে দেখি আমাদের মতো স্পর্শকাতর জাতি নতুন মায়ের মানসিক সুস্থতার প্রতি কি পরিবাণ উদাসীন।
নবজাতকের সুস্থতার খবর সবাই জানতে চায়, কিন্তু মায়ের শরীর ও মনের খোঁজ
নেয় খুব কমই। নবজাতককে দেখতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প
জমানো, দাওয়াত খওয়া, মিষ্টির আবদার এসবের মধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ভুলে যাই প্রসূতী মা ও নতুন
শিশুর একটু নিরিবিলি বিশ্রাম নেয়ার গুরুত্ব। সন্তানের মায়ের দুধ টেনে খেতে শেখার জন্যেও সময় দরকার। শিশু মাতৃগর্ভ থেকেই দুধ খাওয়া শিখে আসে কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। অনেককিছুর উপর এটা নির্ভর করে। সন্তানের জন্মের পর মায়ের সাথে
স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট
বা ত্বকের সংস্পর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেটা আমাদের দেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। যতটা
সময় শিশু মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে থাকবে, তত তার শরীরে
উষ্ণতা বাড়বে, প্রশান্ত হবে, আর মায়ের শরীর
তখন অক্সিটোসিন, প্রোল্যাকটিন, এনডুরফিন নামক হরমোন উৎপাদন করবে। মায়ের দুধের যোগান দিতে এই হরমোনগুলোর প্রভাব
সর্বাধিক। তাই মা ও শিশুর
জন্য প্রথম কিছুদিন নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশ খুব জরুরি। নতুন শিশুর জন্মের পর সবাই হুমড়ি
খেয়ে উপহার নিয়ে দেখতে চলে যাই। নতুন মায়ের জন্য একবেলা খাবার কি নিয়ে যাই
কেউ? নবজাতকে এক বেলা দেখে
রাখার মাধ্যমে নতুন মাকে একটু বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়ার কথা ক’জন ভাবি?
প্রবাস জীবনের সাথে আমাদের দেশের একটা বিশদ পার্থক্য হলো দেশে আমরা আত্মীয়-স্বজন, চেনা পরিচিতরা একে অন্যের সুখে দু:খে পাশে
থাকতে পারি। প্রবাসে এই অভাব প্রতিনিয়ত
অনুধাবন করি। এত মানুষজন চারপাশে
থাকার পরও আমাদের দেশে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুক্তভোগী মায়েদের সংখ্যা কম নয়। নির্ণয়কৃত
রোগী ছাড়াও উপসর্গ রয়েছে ডায়াগনোসিস হয়নি এমন মায়েদের সংখ্যা প্রচুর । এই সময়টাতে
পাশে না দাঁড়িয়ে উলটো
তার ভুল ভ্রান্তিগুলো তুলে ধরতে আর কুসংস্কার কুপ্রথার
বেড়াজালে তাকে কাবু করতে অস্থির হয়ে যাই আমরা। অথচ ভাবি না নবাগত এই
সন্তানের সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে বেড়া
ওঠার পুরোটাই তার মায়ের ভালো থাকার উপর নির্ভরশীল। তাই পারিবারিকভাবে সামাজিকভাবে, জাতীয় পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন শিক্ষা, সচেতনতা, সেবা সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন আর প্রচার প্রসার
প্রয়োজন। কেননা গোড়ায় গলদ রেখে তো আর মহিরুহের
স্বপ্ন দেখা যায় না।
আফগানিস্তান ও জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার আটকে যাচ্ছে মার্কিন কংগ্রেসে!
মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান ও জার্মানি থেকে
সেনা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন
তা আটকে দেয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে কংগ্রেস। নতুন পলিসি বিলের আওতায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আটকে দেবে কংগ্রেস।
আফগানিস্তান
থেকে ২,০০০ এবং
জার্মানি থেকে ১২ হাজার সেনা
প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সেনা প্রত্যাহারের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেবে না কংগ্রেস। ফলে
এ দুটি দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার আটকে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানে সাড়ে চার হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। সেখান থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে
২,০০০ সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। এছাড়া ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্টের আওতায় জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি
আহ্বান জানানো হবে। এর আগে ট্রাম্পের
সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক মিলি।
মার্কিন ও ফরাসি গোয়েন্দা বিমান হটিয়ে দিল রাশিয়ার সুখোই-৩০
বাল্টিক
সাগরের আকাশে আমেরিকা ও ফ্রান্সের একাধিক
গোয়েন্দা বিমানকে তাড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়ার একটি সুখোই এস-৩০ যুদ্ধবিমান।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাল্টিক সাগরের আকাশে আমেরিকা ও রাশিয়ার দু’টি জঙ্গিবিমান ও
একটি মার্কিন জ্বালানী সরবরাহকারী বিমানকে শনাক্ত করে সেগুলোকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
রাশিয়ার
বার্তা সংস্থা স্পুৎনিক এ খবর জানিয়ে
বলেছে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সোমবার বাল্টিক সাগরের আকাশে এমন কিছু লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে যেগুলো রাশিয়ার আকাশসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রাডার ব্যবস্থায় এসব চলমান লক্ষ্যববস্তু ধরা পড়ার পর রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয়
বিমান বহরের একটি সুখোই এস-৩০ যুদ্ধবিমান
আকাশে উড্ডয়ন করে এবং লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।
রুশ যুদ্ধবিমানটি আকাশে মার্কিন বিমান বাহিনীর আরসি-১৩৫ মডেলের একটি গোয়েন্দা বিমান, কেএস-১৩৫ মডেলের একটি জ্বালানী সরবরাহকারী বিমান এবং ফ্রান্সের সি-১৬০ মডেলের একটি গোয়েন্দা বিমানের সন্ধান পায়।এ অবস্থায় সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমানটি আমেরিকা ও ফ্রান্সের বিমানগুলোকে তাড়া করে এবং তাদেরকে বাল্টিক সাগরের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
ব্রিটিশ পানিসীমার কাছে রুশ যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা বেড়েছে: লন্ডন
ব্রিটিশ
পানিসীমার কাছে গত দুই সপ্তাহে
রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা ‘ব্যাপকভাবে’ বেড়ে গেছে বলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী দাবি করেছে।
এক বিবৃতিতে ওই বাহিনী বলেছে, গত দুই সপ্তাহে রাজকীয় নৌবাহিনী ব্রিটেনের আশপাশে নয়টি রুশ জাহাজ পর্যবেক্ষণ করেছে। এসব জাহাজের মধ্যে ছিল একটি সাবমেরিন, একটি ডেস্ট্রয়ার, একটি করভেট, একাধিক টহল জাহাজ ও এগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী টাগবোট ও সরবরাহকারী জাহাজ। বিবৃতিতে বলা হয়, ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর আটটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ইংলিশ চ্যানেল ও সেলটিক সাগরে এসব রুশ জাহাজ শনাক্ত করা হয়।এতে আরো বলা হয়, আকাশ থেকে রুশ জাহাজগুলোকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্রিটিশ নৌবাহিনী। রাশিয়ার স্পুৎনিক বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, অতীতে একই ধরনের ঘটনায় রাশিয়ার নৌবহর কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছাড়াই ব্রিটিশ পানিসীমা অতিক্রম করেছে।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের পর সাইবার হামলার শিকার আরব আমিরাত
ইহুদিবাদী
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির পর সাইবার হামলার
শিকার হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। পারস্য উপসাগরীয় দেশটির সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হামাদ আল-কুয়েতি সম্প্রতি
এ তথ্য জানিয়েছেন।
কয়েক
দশকের আরব নীতি ভেঙে সংযুক্ত আরব আমিরাত গত আগস্ট মাসে
ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়। এতে ফিলিস্তিনি জনগণ এবং বিশ্বের বহু মুসলিম দেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর বাহরাইন এবং
সুদানও ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ অনুসরণ করে।
মোহাম্মদ হামাদ আল-কুয়েতি দুবাইয়ের
এক সম্মেলনে বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর সংযুক্ত আরব
আমিরাতের বিরুদ্ধে কিছু লোকজন ব্যাপকভিত্তিক সাইবার হামলা চালিয়েছে। তিনি জানান সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক সেক্টর লক্ষ্য করেই মূলত এসব হামলা চলে তবে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত
কিছু জানান নি। এমনকি হামলাকারীরা সফল হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও তিনি
পরিষ্কার করে কিছু বলেন নি।
কুয়েতি
স্পষ্ট করে বলেন, করোনা ভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর সংযুক্ত আরব
আমিরাতের বিরুদ্ধে সাইবার হামলা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। তিনি দাবি করেন, সাধারণত বহু হামলা ইরান থেকে হয়ে থাকে তবে সম্প্রতিক হামলার পেছনে কারা ছিল সে কথা তিনি
সুনির্দিষ্ট করে বলেন নি।
ইমরান খানকে মরিয়ম নওয়াজের হুশিয়ারি
পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে মরিয়ম নওয়াজের নেতৃত্বে একাট্টা হচ্ছে
দেশটির বিরোধী দলগুলো। পাক পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ থেকে সম্প্রতি গণইস্তফা দেয়ার কথা রয়েছে বিরোধী দলের সদস্যদের।
এর
মধ্য দিয়ে ইমরান খানের সরকার পতন ঘটানোর হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সহসভাপতি মরিয়ম নওয়াজ।
যদি
এমনটি না-ও হয়,
বিরোধী ১১ দলের জোট
পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) সম্প্রতি একটা বড় সিদ্ধান্ত নেবেন
বলে গণমাধ্যমকে জানিছেন মরিয়ম। খবর জিও নিউজের। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেহাল অর্থনীতির মতো নানাবিধ বিষয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকারের ওপর লাগাতার চাপ বাড়াচ্ছেন বিরোধীরা।
১৬
অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তে অন্তত পাঁচটি সরকারবিরোধী সভা করেছে পিডিএম। পরবর্তী সভা রয়েছে লাহোরে ১৩ ডিসেম্বর। ইমরান
খানের সরকার ওই সভা আয়োজনের
অনুমতি নাও দিতে পারে। যদিও ইমরান খান জানিয়েছেন কাউকে আটকানো হবে না।
কিন্তু
সমাবেশে উপস্থিত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হবে। সম্প্রতি লাহোরে দলীয় সোশ্যাল মিডিয়াকর্মীদের সভায় মরিয়ম এ হুমকি দেন।
ইসলামাবাদকে চাপে রাখতে আমিরাতে পাকিস্তানিদের ভিসা বন্ধ!
ইরানের গোপন পরমাণু তথ্য প্রকাশ করছে আইএইইএ
ইরানের
জাতীয় সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক
কমিশনের চেয়ারম্যান মুজতবা জুন্নুরি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ ইরানের
পরমাণু কর্মসূচির গোপন তথ্য তেহরানের শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছে। এছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ে জাতিসংঘের ওই সংস্থা বিশ্বস্ততা
ভঙ্গ করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি ইরানের বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত তথ্য আইএইএ’র মাধ্যমে ফাস
হয়ে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরে জুন্নুরি সম্প্রতি এক বক্তব্যে আরো
বলেন, আইএইএ’র পরিদর্শক হয়ে
যারা ইরান সফর করেন তাদের অনেকে পশ্চিমা দেশগুলোর গুপ্তচর। এসব গুপ্তচর জাতিসংঘের কর্মকর্তা হিসেবে ইরানে আসলেও এদেশের যেসব তথ্য গোপন রাখার কথা সেগুলো তারা ইরানের শত্রুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সম্প্রতি ইরানের পার্লামেন্টে পাস হওয়া নতুন আইনের কথা উল্লেখ করে জুন্নুরি বলেন, এই আইন বাস্তবায়ন
করলে আইএইএ’র পরিদর্শকরা আর
এই অপকর্মটি করার সুযোগ পাবে না। এর আগে সম্প্রতি
আইএইএ’তে নিযুক্ত ইরানের
স্থায়ী প্রতিনিধি কাজেম গারিবাবাদি বলেছিলেন, আইএইএ’র ইরান সংক্রান্ত
গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেবে তেহরান। তিনি
এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পাশাপাশি আইএইএ’র সঙ্গে তেহরানের
চিঠি আদান-প্রদানের সব তথ্য গোপন
দলিল হিসেবে পরিগণিত; কাজেই এই গোপন দলিল
ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজে ছেড়ে দেবে না ইরান।
পশ্চিমা
কিছু গণমাধ্যম সম্প্রতি খবর দেয়, আইএইএ তার সদস্য দেশগুলোর কাছে এ তথ্য প্রকাশ
করেছে যে, ইরান তার নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় অত্যাধুনিক আইআর-২এম সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গারিবাবাদি
বলেন, আইএইএ’র গোপন প্রতিবেদন
পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা এর আগেও একাধিকবার
ঘটেছে। কিন্তু এবার তেহরান আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার লক্ষ্যে সেদেশের পার্লামেন্ট সম্প্রতি এক আইন পাস
করার পর পশ্চিমা গণমাধ্যমে
এ খবর প্রকাশিত হলো। ইরানি পার্লামেন্টের আইনে বলা হয়েছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে ইরানের ওপর থেকে আমেরিকার একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে নাতাঞ্জ
পরমাণু স্থাপনায় অন্তত ১,০০০ আইআর-২এম সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন করতে হবে।
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে ভিন্ন পথে আরব নেতারা
ইসরাইলকে
স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে কয়েকটি আরব রাষ্ট্র বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত পাকিস্তানের ওপর ব্যাপক চাপসৃষ্টি করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আছে সৌদি আরবও। চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত পাকিস্তানের নাগরিকদের শ্রম ও ভ্রমণ ভিসা
ইস্যু করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। খবর প্রেসটিভি ও ডেইলি সাবাহর।
পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন সরকার
ইসরাইল এবং ভারতঘেঁষা নীতিগ্রহণ করে ইসলামাবাদকে ভিন্ন বার্তা দিতে চাইছে।
আরব
আমিরাত ও সৌদি আরবে
পাকিস্তানের ৫০ লাখের বেশি
শ্রমিক কাজ করে। আরব রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। সম্প্রতি
পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব
ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ব্যাপক চাপ সৃষ্টি সত্ত্বেও ইমরান খানের সরকার নতিস্বীকার না করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছে। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ায় আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে পাকিস্তানের জনগণ রাজধানী ইসলামাবাদসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ অবস্থায় ইমরান
খান সরকারের সামনে দুটি পথ রয়েছে বলে
বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া অথবা আরব রাষ্ট্রগুলোর শাস্তির মুখে পড়া।
তবে
পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে- ইরান, তুরস্ক, কাতার ও চীনের সমন্বয়ে
যে জোট গড়ে উঠতে যাচ্ছে তাতে যুক্ত হবে পাকিস্তান। এর বিপরীতে থাকবে
আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত ও কয়েকটি আরব
রাষ্ট্রের জোট।
বিশ্ব বাজারে চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশি ওষুধের
দেশীয়
প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎকৃষ্টমানের ঔষধ প্রস্তুত হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে ১৪৮টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে।
ঔষধ
প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো.মাহবুবুর রহমান
এসব কথা বলেন। সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেতে তামান্না ফার্মেসির উদ্যোগে লেকসিটি এবং মিরপুরে দুটি মডেল ফার্মেসি উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেছেন, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ঔষধ বিক্রি করা যাবে না।
ঔষধ
প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো: মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, আগামী দুবছরের মধ্যে দেশের সকল ঔষধ ফার্মেসিকে মডেল ফার্মেসি অথবা মডেল মেডিসিন শপে পরিণত করার সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে ঔষধ প্রশাসন। ঔষধের গুণগত মান বজায় রেখে সঠিক ঔষধ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে মডেল ফার্মেসি কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, তাপমাত্রার হেরফের হলে অরেক ঔষধের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তাই ফার্মেসিগুলোর পরিবেশ আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে ঔষধ প্রশাসন। তারই অংশ হিসেবে মডেল ফার্মেসি বা মডেল মেডিসিন
শপ প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এ সময় উপস্থিত
ছিলেন।বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোসাদ্দেক হোসেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, তামান্না মডেল ফার্মেসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন মৃধা বেলু, সিনিয়র সাংবাদিক কনক সাহা প্রমুখ।
উন্নয়নে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ- এরপরেও সুকৌশলে রাজ্য দখলের চেষ্টা বিরোধীদের
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন দেখছে, মানুষ যত দেখছি তত
হতাশ হয়ে পড়ছে এবং রাজ্যের শাসক দল বিরোধী মনোভাব
তৈরি করে দিচ্ছে বিরোধী দলগুলি। দুয়ারে দুয়ারে সরকার। এই কথাটি যেভাবে
রাজ্যের একেবারে গ্রহণযোগ্য জায়গায় মানুষ গ্রহণ করেছে। ঠিক এর উল্টোটা বিরোধীরা
সুযোগ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে, প্রতিটা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এক ধরনের প্রচার
হচ্ছে, যে সরকারকে তোমার
বাড়ি এসে পৌঁছেছে সবার বুকে একটাই কথা না। অনেকে ছোট ছোট সমস্যার সমাধান হয়নি, গভীর জলে চলে গেছে বাম আমল থেকেই। তেমনি গ্রাম বাংলার বহু পরিবার রয়েছে।তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝেনা হচ্ছে সরকার ভাওতা দিচ্ছে, ভোটের আগে মানুষকে ভুল বুঝাচ্ছে আদপেই তোমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। ঠিক উল্টো টাই বোঝানো হচ্ছে, গ্রামবাংলায় গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন সাংবাদিক পরিবারের উপরে কেমনি অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং সবকিছু দিচ্ছে না এটা কিন্তু
বাংলা পরিনাম ভয়ঙ্কর। মানুষ সত্যিকারে সমস্যায় জর্জরিত তাই বিরোধী দলের কথাগুলো তাদের কানে বাজছে। সেই কারণে যদি বাংলার উন্নয়ন কে সামনে রেখে
মানুষের সমস্যার সমাধান করতে হয়, তাহলে দিদিকে আরো কৌশলী হতে হবে। সত্যিকারে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে রাজ্যস্তর থেকে সরকারি প্রতিনিধি পাঠিয়ে সমস্যার সমাধানের খোঁজ নিতে হবে। আর করা যেতে
পারে বাংলায় সৎ নিষ্ঠাবান সাংবাদিককে
সামনে রেখে তাদের কাজ দিয়ে খোঁজ নিতে হবে, কোন সমস্যার প্রকৃত ঘটনা কি আছে। দিদির
উন্নয়নের সুযোগ নিয়ে আজকের বাংলার নেতারা কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। এসব গ্রাম বাংলার লোক দেখতে দেখতে তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সত্যগুলো জানিনা কেন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কাছে খবরটি পৌঁছাচ্ছে না। যাক এসব কথা আজকেরে আমার লেখার একটাই কারণ বাংলার উন্নয়ন দেখে, আগামী দিনে মানুষকে ভোট দেবে প্রশ্নচিহ্ন সামনে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই লেখাটি বাংলার শাসক দলের কাছে অপ্রিয় সত্য হলেও সত্যি কথাটা আমি তুলে ধরব একদিকে উন্নয়ন আরেকদিকে বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি। দুইয়ের মাঝে বাংলা যেন আজকের বিপদগ্রস্ত, বাংলার উন্নয়ন যতটা মানুষের মধ্যে প্রভাব পড়েছে, ততটাই ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেনি নেতারা। বা পুলিশ-প্রশাসনের
একাংশ, সেই কারণে এর প্রভাব ভোটব্যাংকে
যেতে পারে আগামী বিধানসভা ভোটে।
বাংলার
উন্নয়নের হাতিয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উন্নয়নের দিক আমি এই লেখার মধ্যে
তুলে ধরছি। বাংলার উন্নয়ন নিয়ে তোপ দাগা বিজেপিকে কার্যত সম্প্রীতি তুলোধনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এদিন গত ১০ বছরে
রাজ্যে করা তাঁর উন্নয়নের খতিয়ান দিয়ে বলেন, ‘বাংলায় অনেক হয়েছে, বলতে গেলে রামায়ণ-মহাভারত-কোরান-বাইবেল সব শেষ হয়ে
যাবে। রাজ্যে সব উন্নয়নের কাজ
হয়েছে। সেই দিকে রাজ্যে উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী। রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী, ঐক্যশ্রী, শিল্পশ্রী, সমব্যথী থেকে শুরু করে একজন মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রের সঙ্গেই
এই সরকার জুড়ে রয়েছে। মানুষকে একটু সুবিধা দিতেই এই প্রকল্পগুলি নেওয়া
হয়েছে। এতে বহু মানুষই উপকৃত হবেন। এ ও মুখ্যমন্ত্রী
জানান, গত ৮ বছরের
মধ্যে ৮টা নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে সময় পেয়েছি মাত্র পাঁচটা বছর। তাতেই এত কাজ করা
হয়েছে। যা বাংলায় কেউ
কোনওদিন ভাবতেই পারেনি। পাশাপাশি, এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানান, জানুয়ারি থেকে রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বেতন এক হাজার টাকা
করে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও, সিভিক ভলিন্টিয়ার, মিড ডে মিল-সহ
যে ক্ষেত্রগুলি রয়েছে তা দেখে নেওয়া
হয়েছে বলেই জানান তিনি। পাশাপাশি, এদিন তিনি স্পষ্টই জানান, যে বা যারা
বাইরে থেকে এসে রাজ্যে গুন্ডামি করছে তারাই বহিরাগত। যারা রাজ্যে এসে থেকে রাজ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন তারা বহিরাগত নয়। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে তোপ দেগে মমতা বলেন, ‘একটা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরসভার নির্বাচন করছে। দেশের কী অবস্থা তা
স্পষ্ট। দেশের সীমান্তের কি অবস্থা, অর্থনীতিতে
ধস নামছে, সে সব দিকে
নজর নেই। শুধু ভোট। পরিস্থিতি এতটাই নিচে নেমেছে যে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে
পুরসভার নির্বাচন করতে হচ্ছে। কারও বাড়িতে এসে রান্না করে খাবার খাচ্ছে, ছবি তুলছে। কিন্তু দেশের কী অবস্থা, কেউ
দেখছে না। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির ‘বহিরাগত’ নিয়ে কথা তুলতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। আগমী এপ্রিল থেকে মে মাসে এই
রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনে
ভোট
গ্রহণের কথা। সেই নির্বাচন সামনে রেখে এখন উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে রাজ্য রাজনীতি। রাজ্যের প্রধান দল তৃণমূল কংগ্রেস,
বিজেপি, জাতীয় কংগ্রেস ও বাম দল
ইতিমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে জয়ের আশা নিয়ে মাঠে নেমেছে বিজেপি। বিজেপির কেন্দ্রীয় পাঁচ নেতাকে রাজ্যে নির্বাচন তদারকির জন্য পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সুনীল দেওধর, বিনোদ সোনকার, বিনোদ তাওড়ে, দুষ্মন্ত গৌতম ও হরিশ দ্বিবেদি।
তাঁরা কেউই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা নন।
তারা
বুথ স্তর পর্যায়ের নির্বাচনী কাজ শুরু করেছেন। এই নেতাকে
‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের এ প্রচারে অসন্তুষ্ট
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সম্প্রীতি বুধবার সকালে কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটে তিনি বলেন, বাংলার উন্নয়নে অবাঙালিদের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু তারা বহিরাগত নন। ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলায় বাইরের মানুষ এসে এখানে বসতি স্থাপন করে উন্নয়নে শরিক হয়েছেন। তাদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তাঁদের অবদান অনেক বেশি। কেন এই বহিরাগত প্রশ্ন
আসবে? শাসকের বিরোধীদের নিজেদের দোষ ঢাকতে একে অপরের উপরে ইচ্ছাকৃত চাপা উত্তেজনা দোষ চাপিয়ে যাচ্ছে। এটা যেমন সত্য কথা ঠিক আরেকটি সত্য কথা অস্বীকার করা যাবে না বাংলার মানুষ
ও পারবেনা, উন্নয়ন হয়েছে এই বাংলায়। ঠিক
এর উল্টোটা বলতে গেলে বলতে হয়,বাংলায় উন্নয়নের
সাথে সাথে অনেক অবনতি হয়েছে। অনেক জায়গায় খাতা-কলমে উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। প্রত্যন্তগ্রামের মানুষের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে কোন না কোন সমস্যা
রয়ে গেছে। গ্রাম্য সাংবাদিকদের আজও প্রাধান্য দেয় নি পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেটা কর্ণপাত করেননি। কি কথা গুলো
ঠাকুর সত্যের মতো। অন্যদিকে এও বলা যেতে
পারে,করোনা আবহেও বাংলায় কর্মসংস্থান হয়েছে বলে আগেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি আরও একবার সেই খতিয়ানই তুলে ধরলেন তিনি।
মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) আশ্বাস আরও কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত হচ্ছে রাজ্যে। এর আগে সাধারণ
মানুষকে রাজ্যের প্রকল্পগুলির সুবিধা সম্পর্কে বোঝাতে ‘দুয়ারে দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিও গ্রহণ করে সরকার। দুয়ারে দুয়ারে সরকার গিয়ে সত্যি মানুষের কতটা সমস্যার সমাধান হবে এ নিয়েপ্রশ্ন চিহ্ন
উঠেছে গ্রাম-গঞ্জ থেকে। সব প্রকল্প এর
অপব্যবহার হচ্ছে গ্রামগঞ্জে। প্রকৃত মানুষের সমস্যার সমাধান হয়নি,উন্নয়নের তো মানুষের জন্য
তাহলে মানুষের সমস্যার সমাধান হবে না কেন।সেই প্রসঙ্গে
বলতে গেলে বিগত সরকারের কথা উল্লেখ করতে হয়।বাম আমলের ৩৪ বছরের বিশাল
দেনা রাজ্যের ঘাড়ে এখন পাহাড় প্রমাণ চাপ হিসাবে সামনে দাঁড়িয়েছে। ৩৪ বছর ধরে
সিপিএম
হার্মাদরা রাজ্যে কোনও উন্নয়নের কাজ করেনি। উল্টে তারা শুধু বছরের পর বছর দেনা
করে গিয়েছে। সেই দেনার টাকায় পকেট ভরিয়েছে সিপিএমের হার্মাদরা ও টাকার পাহাড়
গড়া হয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। হার্মাদদের এই টাকা চুরির
পিছনে বরাবর সাহায্য করে গিয়েছেন দিল্লির কংগ্রেস নেতারা। সিপিএম সরকার যখন এইভাবে বছরের পর বছর দেনা
বাড়িয়েছে, তখন চুপ করে থেকেছে কংগ্রেস। বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন বাম আমলের এই বিপুল ঋণের
বোঝা থেকে রাজ্যকে সাময়িক রেহাই দেওয়া হোক।
মুখ্যমন্ত্রীর
তাঁর আর্জি নিয়ে কেন্দ্রের কাছে একাধিকবার চিঠিও দিয়েছিলেন। অতীতের কংগ্রেস সরকার যেমন সিপিএম হার্মাদদের দেনা করে টাকা চুরিতে কোনও বাধা দেয়নি, তেমনই বিজেপি সরকারও বাংলার জননেত্রীর আর্জিতে কোনও সাড়া দেয়নি। বিজেপি কখনওই বাংলার উন্নয়ন চায় না। বাংলার উন্নয়ন চায় না বলেই তারা
বাম আমলের ঋণের বোঝা থেকে রাজ্যকে সাময়িক রেহাই দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই করেনি। বাম আমলের ঋণের বোঝা সুদে-আসলে বাড়তে বাড়তে এখন কার্যত হিমালয় পর্বতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমান আর্থিক বছরে সুদে-আসলে ঋণের বোঝা পৌঁছেছে ৫৬ হাজার কোটি
টাকায়। এই টাকাটা বছরের
শুরুতেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাজ্যের
কোষাগার থেকে কেটে নেয়। এমনিতেই রাজ্য সরকারের আয়ের বিশেষ সূত্র নেই। কিন্তু সংবিধানে যেভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে
দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া আছে, তাতে রাজ্যের আর্থিক দায় বিপুল। এই বিপুল আর্থিক
দায় রাজ্যকে সামলাতে হয় তার সামান্য
আয় থেকে। টাকার ঘাটতি পড়লে কেন্দ্র সরকার নোট ছাপাতে পারে। যে সুযোগ রাজ্যের
নেই। কিন্ত সীমিত আয়ের মধ্যে বাম সরকারের আমলে তৈরি হওয়া বিশাল ঋণের বোঝা সামলে রাজ্য সরকার গত আট বছর
ধরে বিরাট উন্নয়নের কাজ করে যেতে সক্ষম হয়েছে। গত আট বছরে
রাজ্যে যে পরিমাণ উন্নয়নের
কাজ হয়েছে, তা অতীতে বাংলায়
কোনও সরকার করে দেখাতে পারেনি। এমনকী দেশের মধ্যেও গত আট বছরে
এই রাজ্যের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ মডেল হয়ে গিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের কারণেই। বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মাত্র আট বছরে বাংলাকে
এই জায়গায় এনে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে বাংলার উন্নয়নের প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, “দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলা প্রথম। এছাড়া ই-গর্ভনেন্স, ই-টেন্ডার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে
বাংলা প্রথম। ক্ষুদ্রশিল্পের উপর আমরা নির্ভরশীল। রাজ্যে ১০ লক্ষ আইটি
কর্মী রয়েছেন। বাংলায় বেড়েছে জিডিপি। ২.৫ শতাংশ
জিডিপি বৃদ্ধি হয়েছে। উইপ্রোতে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। মহামারী কেটে যাবে। তবে রাজ্যের শিল্প, উন্নয়ন থেকে যাবে। টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসও এ রাজ্যে বিনিয়োগ
করেছে। তৈরি হচ্ছে সিলিকন ভ্যালি, আইটি হাব। আইটিসি, টিসিএস, ইনফোসিসের মতো সংস্থার মাধ্যমে এ রাজ্যে কর্মসংস্থানের
বন্দোবস্ত করেছে।”
করোনা মোকাবিলায় দেশজুড়ে জারি হয় লকডাউন (Lockdown)। তার ফলে
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্ট সঙ্গীণ। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তবে এই পরিস্থিতিতেও বাংলাতে
কর্মসংস্থান বেড়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনা কালে রাজ্যে কর্মহীনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে পোর্টাল। যার মাধ্যমে ভিনরাজ্য থেকে ফেরা আইটি কর্মীরা সুবিধা পেয়েছেন বলে দাবি মুখ্যমন্ত্রীর। এও বলতে হয়।
৫৬ হাজার কোটি টাকা একটি আর্থিক বছরে দেনা শোধ করে এই পরিমাণ উন্নয়নের
কাজ দেশের আর কোনও সরকার
করে দেখাতে পারেনি। আগামিদিনেও করতে পারবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে প্রথম যে কাজে নজর
দিয়েছিলেন তা হল রাজকোষের
নিজস্ব আয় বাড়ানো। মুখ্যমন্ত্রীর
চেয়ারে বসার পর মাত্র এক
বছরেই তিনি রাজ্যের নিজস্ব আয়কে দ্বিগুণ করেছিলেন। রাজ্যের নিজস্ব আয় দ্বিগুণ করার
জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে কোনওভাবেই রাজ্যবাসীর উপর বাড়তি করের বোঝা চাপাতে হয়নি। বরং তিনি জ্বালানি তেল-সহ অন্য অনেক
ক্ষেত্রেই রাজ্যবাসীকে করের বোঝা থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। করে নিজস্ব আয় মুখ্যমন্ত্রী বাড়াতে
পেরেছেন সম্পূর্ণই তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের গুণে।
বাম আমলে রাজ্যের আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে
কোনও উদ্যোগই ছিল না সিপিএমের হার্মাদ
নেতাদের। তারা দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে কিছু ভাবতেই পারতেন না।
কীভাবে
রাজ্যের আয় বাড়ানো যেতে
পারে, কোন ক্ষেত্রে চুরি বন্ধ করা যাবে, কোন ক্ষেত্রে আধিকারিকদের উদ্যোগী করে বাড়তি আয়ের বন্দোবস্ত হবে ইত্যাদি ব্যাপারে সিপিএমের হার্মাদ নেতাদের কোনও ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল
না। এর ফলে পুরোপুরি
ভুগতে হয়েছে রাজ্যবাসীকে। রাজ্যের নিজস্ব আয় বাড়ানোটাকে তাঁর
লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে তিনি উদয়স্ত পরিশ্রম করেছেন। নেতা যদি সারাদিন পরিশ্রম করেন, তাহলে অন্যানরাও স্বাভাবিকভাবে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে
বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর সেই কাজটিই
হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরিশ্রম ও দায়বদ্ধতা দিয়ে
গোটা রাজ্য
প্রশাসনকে
উদবুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। কীভাবে রাজ্যের আয় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর
প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তা রূপায়ণ করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরিকল্পনা সফলভাবে রূপায়ণ করতে পারাতেই রাজ্যের আয় দ্বিগুণ হয়েছে।
রাজ্য তার নিজস্ব আয় দ্বিগুণ না
করতে পারলে এই উন্নয়ন কোনওভাবেই
সম্ভব ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার বাম আমলের ঋণের বোঝা বাবদ রাজ্যের কোষাগার থেকে বছরে ৫৬ হাজার কোটি
টাকা কেটে নিচ্ছে। রাজ্যের কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা দিতে
এক বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে। এই টাকাও ৫০
হাজার কোটি টাকার কম নয়। তার
পরেও শুধুমাত্র উন্নয়নের জন্য বছরে ৫০ হাজার কোটি
টাকার বেশি বরাদ্দ করা চাট্টিখানি কথা নয়।
গত আট বছর ধরে
বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অসম্ভব কাজটিই
সম্ভব করে আসছেন। আসলে বাংলার সরকার অতীতে প্রশাসনের শীর্ষপদে এইরকম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেখেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব , পরিকল্পনা রচনা করার দক্ষতা এবং প্রশাসনকে চালানোর ক্ষমতা এই অসম্ভবকে বছরের
পর বছর সম্ভব করে তুলেছে। রাজ্যবাসীদের পক্ষে এটা চরম সৌভাগ্য যে তারা প্রশাসনের
শীর্ষে এইরকম এক নেতৃত্বকে পেয়েছে।গত
আট বছর ধরে বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে উন্নয়নমূলক কাজ
রাজ্যে হয়েছে, তাতে নিশ্চিত করেই এই রাজ্যকে এক
নতুন শিখরে পৌঁছে দেবে। গোটা দেশে অর্থনীতিতে যখন বিরাট মন্দা নেমে এসেছে, তখন এই রাজ্যে বার্ষিক
আয়বৃদ্ধি এক রেকর্ড উচ্চতায়
পৌঁছে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান তথা জিডিপি বৃদ্ধির হার ১২.৬৮ শতাংশ।
যা গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবেই দেশের জিডিপি
বৃদ্ধির হার প্রতি বছরই কমছে। কমতে কমতে তা এখন ছয়ের
ঘরে চলে গিয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবই বলছে, রাজ্যের জিডিপি বৃদ্ধির হার সর্বকালীন রেকর্ড ১২.৬৮ শতাংশ।
এটা সম্ভব হয়েছে বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সরকার উন্নয়নমূলক কাজে গত আট বছর
ধরে এত বিপুল টাকা
খরচ করেছে যে তার সুফল
আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ার মধ্য দিয়ে রাজ্য ভোগ করছে। গোটা দেশেই বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমছে। শিল্পোদ্যোগীরা বেশ কিছুদিন হল লগ্নি করার
ক্ষেত্রে কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বেসরকারি খাতে লগ্নি ভয়ংকরভাবে কমে যাওয়ায় দেশের আর্থিক হাল প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বারবার আর্জি জানাচ্ছে এই বিষয়ে কেন্দ্রীয়
সরকার ভাবনাচিন্তা করুক। কিন্তু কেন্দ্রের এ নিয়ে কোনও
হেলদোল নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরেরা প্রতিদিন বিবৃতি দিচ্ছেন।
তাঁরা পর্যন্ত সরকারকে উদ্যোগ নিতে বারবার অনুরোধ করছেন। এক্ষেত্রে দেশের মধ্যে একমাত্র উদ্যোগী হয়েছেন বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি রাজ্য
সরকারের সীমিত আর্থিক ক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আজকে যদি পশ্চিমবঙ্গ বিপুল টাকা খরচ না করত, তাহলে
এই রাজ্যেও আর্থিক মন্দা ভয়াবহ চেহারায় আত্মপ্রকাশ করত। বাম আমলে এই রাজ্যে শিল্পের
সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। এখানে কলকারখানা বাম আমলে উঠে গিয়েছে। তার উপর বেসরকারি লগ্নি নেই। রাজ্যের জনসংখ্যাও বিপুল। এই বিরাট জনসংখ্যাকে
বাঁচিয়ে রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উদ্যোগ। বছরে ৫০ হাজার কোটি
টাকার উপর রাজ্য সরকারের উন্নয়নী ব্যয় অন্য কোনও রাজ্য কল্পনাই করতে পারে না। বাংলায় সেটাই সম্ভব করে দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারের উন্নয়নমূলক খরচ বাঁচিয়ে রেখেছে রাজ্যের দশ কোটি মানুষকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে তাঁর সরকার পরিচালনা করছেন, তা গোটা দেশের
সামনে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে অন্য রাজ্যের সরকারগুলিও ভাবতে শুরু করেছে
আর্থিক মন্দা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের কী ভূমিকা হওয়া
উচিত। কেন্দ্রীয় সরকার তার কোনও দায়িত্ব পালন করছে না। এই আর্থিক মন্দার
মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ টাকা
লগ্নি করা উচিত, তার ছিটেফোঁটাও তারা করছে না। এইভাবে রাজ্য সরকার পাশে না দাঁড়ালে বাংলার
অর্থনীতির হাল ভয়াবহ হবে। বাংলাকে এইভাবে রক্ষা করছেন একমাত্র বাংলার জননেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁর নেতৃত্বে
বাংলা যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে আগামিদিনে এই রাজ্য আরও
অনেক দূর এগোবে। বাংলার আর্থিক বৃদ্ধির এই হার বজায়
থাকলে ঘাড়ে ৫৬ হাজার কোটি
টাকার দেনার
বোঝা
নিয়েও বাংলা সবদিক থেকে এগিয়ে যাবে। বাংলার উন্নয়ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গতি লাভ করেছে, তাকে আর কোনওভাবেই ঠেকানো
সম্ভব নয়। যদিও এই রাজ্যে ক্ষমতা
দখলের উদ্দেশ্যে বিজেপি নানাভাবে চেষ্টা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে বানচাল করতে। বিজেপির এই চক্রান্ত এই
রাজ্যের মানুষ সফল হতে দেবে না।
শাহ্
ফুয়াদ ॥ সূফী সাধক
আনোয়ারুল হক-এঁর যোগ্য
উত্তরসূরী সমাজ-গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী সূফী
সাধক শেখ আব্দুল হানিফ বাংলাদেশে আদর্শিক সাংবাদিকতার পতাকাটি ধরে রেখেছিলেন শক্ত হাতে, দৃঢ় প্রত্যয়ে। কর্ম-মানবতা-শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘আমরা নিরপেক্ষ নই, সত্যের পক্ষে’এই শ্লোগানকে সামনে
রেখে দীর্ঘ ২৬ বছর বর্তমান
সংলাপ নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে যে উদাহরণ তিনি
সৃষ্টি করেছেন তা দেশের সাংবাদিকতার
ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। আদর্শিক সাংবাদিকতার প্রদীপটি যারা ধারণ, পালন ও লালন করতে
চায় তাদের জন্য তিনি ‘শুকনো গাছের মরা ডালে ফুল ফোটানো’র মতো কাজটি
করেছেন এতটা বছর। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন, সংবাদপত্র প্রকাশনার সুযোগ-সুবিধা এবং সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কারণে কর্পোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম জগৎটির কাছে এদেশের আদর্শিক সাংবাদিকতার আলোটা যখন নিভু নিভু, তখন তিনি তাঁর শ্রম-সময়-সুশিক্ষা-স্বশিক্ষা-মেধা-মনন-চিন্তা-চেতনা-ব্যবস্থাপনার অপূর্ব দক্ষতা দিয়ে ‘বর্তমান সংলাপ’কে তিনি দীর্ঘ
২৬ বছর টেনে এনেছেন।
সাংবাদিকতা
তথা গণমাধ্যম জগৎটির নিয়ন্ত্রণ এখন অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের হাতে নেই, ব্যবসায়ীদের হাতে, যা এদেশের ঐতিহ্যবাহী
সাংবাদিকতার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পথে একটি ছন্দপতন বটে। এই পরিস্থিতির দায়ভার
কে নেবে ? বা আর এ
পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী এবং
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী কী পদক্ষেপ
গ্রহণ করা যায়-এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজতে গেলে সম্পাদক-সাংবাদিক শেখ আবদুল হানিফ-এঁর প্রবর্তিত ধারাটি কাজে আসতে পারে। বিগত ২৬ বছরে বাংলাদেশে
অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র
বের হয়েছে, কিন্তু নানামুখী দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের সংঘাতে
এবং বিশেষ করে লক্ষ্যচ্যূত হওয়ায় অথবা পত্রিকা প্রকাশের আদৌ কোনো লক্ষ্য না থাকার কারণে
অধিকাংশ সংবাদপত্রই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। বর্তমানে কোনো কোনো সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিন (ইলেক্ট্রনিক)
মাধ্যম বিভিন্ন ব্যবসায়িক কৌশল প্রয়োগ করে প্রতিপত্তি অর্জন করলেও এই জগতের ভেতরের
অবস্থাটি কী যে ভীষণ
রকমের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে তা একমাত্র এর
ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। এর সবচেয়ে বড়
কারণ, এসব সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে কোনো আদর্শিক বা মহৎ কোনো
লক্ষ্যের চাইতে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ব্যবসায়িক স্বার্থই বেশি ছিল। ফলে বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সাংবাদিকতার অবাধ
স্বাধীনতা থাকলেও সেই স্বাধীনতা ভোগ করছে সংবাদপত্রের ব্যবসায়িক মালিকগণ, কর্মরত সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথৈবচ।
অবস্থা
এমন দাঁড়িয়েছে যে, সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী সবচেয়ে মেধাবীরা এখন সংবাদপত্রের কাজে প্রবেশ করতে চায় না, এর পরিবর্তে তারা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হওয়া সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিচ্ছে। এ অবস্থা কিন্তু
১৫/২০ আগেও ছিল
না। অর্থাৎ, বলা চলে মেধাবীরা সাংবাদিকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বা ফেলছে। অপেক্ষাকৃত
কম মেধাবীরা এবং অনেক ক্ষেত্রে মেধাহীনরা সাংবাদিকতার বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করছে যা সারা দেশে
সাংবাদিকতার সামগ্রিক পরিস্থিতিতেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতার নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা এমনকি অবৈধ ও সমাজবিরোধী ঘটনা
ঘটছে যা বিবেকবান ও
সচেতন মহলের জন্য বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা থেকে
অবশ্যই উত্তরণ ঘটাতে হবে সাধারণ মানুষ, সমাজে ও দেশের স্বার্থে।
এ প্রেক্ষাপটে শেখ আবদুল হানিফ সম্পাদিত বর্তমান সংলাপ এর প্রকাশনা এই
বার্তা-ই দেয় যে,
লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে সততা ও আন্তরিকতার সাথে
চলতে পারলেই কেবল সাংবাদিকতার ঐতিহ্য ও মর্যাদা সমুন্নত
রাখা যায়। সাংবাদিকতা নিছক চাকুরি বা রুটি-রুজির
উপায় নয়, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করতে না পারলে সমাজের
অনিষ্ট করার আশঙ্কাই বেশি থাকে।
এদেশের
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ঐতিহ্যগতভাবে
দেশ, জাতি ও সমাজ তথা
বিশ্ববিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ। আর এই দায়বদ্ধতার
কথা যে অস্বীকার করবে,
তাকে সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা না
বলাই শ্রেয়।
দেশ ও
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা যাদের
হাত ধরে উন্মেষিত ও বিকশিত হয়েছিল
সেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়, জন ক্লার্ক মার্শম্যান,
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশ চন্দ্র মুখার্জী, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, বিপীন চন্দ্র পাল, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কমরেড মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন,এঁর মতো মনিষীদের কেউ ছিলেন শিক্ষক, মিশনারি, কেউ কবি বা সাধক, আবার
কেউ বা একাধারে ছিলেন
বিপ্লবী, বড় মাপের রাজনীতিক,
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। পরাধীন
দেশ ও দেশের মানুষের
মুক্তি আর অপশক্তির মুখোশ
উন্মোচন করে জনগণের রাজত্ব কায়েম করা, সে লক্ষে তাদেরকে
উদ্বুদ্ধ করে জনমত তৈরি করাই ছিলো তাঁদের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের
ব্রত। ১৯২২ সালে সাংবাদিক-কবি কাজী নজরুল ইসলামের পত্রিকা ‘ধূমকেতু’তেই সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে পূর্ববাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষের মাথার উপর চেপে বসা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে সচেতন করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এদেশের একদল মনীষী রাজনীতি ও সাংবাদিকতাকে এক
সাথে পুঁজি করেই। এঁদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগৎটি
অর্জন করেছিল সম্মোহনী শক্তি। এ পর্যায়ে পূর্ব
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, খায়রুল কবীর, রণেশ দাসগুপ্ত, জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নূর উদ্দিন, আব্দুস সালাম, মাহবুবুল হক, সিকান্দর আবু জাফর, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক
ব্যক্তিবর্গের নাম বাঙালির মানসপটে চিরভাস্বর হয়ে আছে। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আবুল
মনসুর আহমদের পক্ষে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর’-এর মতো অবশ্য
পাঠ্য গ্রন্থ লেখা সম্ভব হয়েছিল জনগণের প্রতি তাঁরা দায়বদ্ধ ছিলেন বলেই।
উল্লেখ্য
যে, আজকের বাংলাদেশে ‘জননী সাহসিকা’র মর্যাদায় আসীন
কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মালিকানা এবং পরিচালনায় কবি নজরুল ইসলাম বের করেছিলেন কলকাতার প্রথম সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’। স্বাধীন রাষ্ট্র
বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ও সংগ্রামীজীবনের চালিকাশক্তিই
ছিলো আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাক এবং এর সম্পাদক তাঁর
অগ্রজপ্রতিম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। পত্রিকাটি প্রথম সাপ্তাহিক হিসেবে বের করেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানী আমলে দৈনিক ইত্তেফাকই বাঙালির
স্বাধীকারের চেতনাকে জনগণের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিলো সফলভাবে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে এদেশের প্রগতিশীল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জ্বল
ভূমিকাও অনস্বীকার্য। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী আমলে সাড়া-জাগানো ‘সমকাল’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক এবং সমকাল প্রকাশনীর কর্ণধার সিকান্দর আবু জাফর কর্তৃক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই ’ গানটিতেই প্রথম বলা হয়েছিল, ‘প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত’। আর পাকিস্তানী
হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ এবং
বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে যেভাবে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছিল
তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ওইসব সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক-সাংবাদিকদের সবাই ছিলেন দেশ, জনগণ ও তাদের নিজেদের
বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ আর সে কারণে
আজও তাঁদেরকে স্মরণ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে।
সাংবাদিকতা-সাহিত্য ও রাজনীতির জগতের
সেইসব মনীষীদের আজীবন সংগ্রাম ও সাধনার ফসল
হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা যে
এক সম্মোহনী ও আকর্ষনীয় শক্তির
অধিকারী হয়ে উঠেছিলো, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর
আজ তার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে দীর্ঘ
প্রায় ৫০বছর এদেশের সাংবাদিকতার
দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদেরই একজন ওয়াহিদুল হক যিনি এদেশের
মানুষকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জাগরণেরও একজন অগ্রপথিক। তাঁর
ভাষায়, ‘বাংলার প্রেস আজ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম
ম্যানেজড প্রেসের একটি। এটি এখন কোনক্রমে রাষ্ট্রীক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে
পরিমাণ ও গুণগতভাবে বৃদ্ধি
করার কোন প্রতিষ্ঠান নয়। আবদ্ধ প্রেস অন্ধকারে ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ
প্রাণীর মতোই বিকাশহীন ও পচনশীল হতে
বাধ্য। এতসব বাধাবন্ধের পরেও বাংলাদেশের প্রেসের মূলধারা এবং প্রবণতাটি দালালির বিপরীতে। বীরত্বের প্রবণতা তার। (তথ্য সূত্র -স্বাধীনতা
ও সংবাদপত্র, দৈনিক সংবাদ এর বর্ষপূর্তি সংখ্যা,
২৬মে, ২০০৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১২।
)
সাপ্তাহিক
বর্তমান সংলাপ-এর যুগপূর্তি উপলক্ষে
৩ মার্চ, ২০০৬ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সত্য প্রকাশ ও তথ্য জানার
অধিকার ঃ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
সংবাদমাধ্যম’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা
অনুষ্ঠিত হয়। এতে বলা হয়, ‘যে নিজে সত্যের
উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তার পক্ষে সত্যকে তুলে ধরা সম্ভব নয়। অসত্যকে ধারণ করে যার বিকাশ, অসত্যের সঙ্গে যার নিরন্তর বসবাস, তার পক্ষে সত্য প্রকাশ করতে পারার কথা নয়; সেরূপ আশা করাও বৃথা। দেশের সংবাদ মাধ্যমের দিকে তাকালে এই সত্যই ধরা
পড়ে বারবার”। বক্তারা আরও
বলেন, সত্যের উপর নিজে প্রতিষ্ঠিত না হলে সত্য
তুলে ধরা যায় না। দেশের
সংবাদমাধ্যমে কর্মরত প্রথম সারির সাংবাদিক ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞগণ
প্রায় সমস্বরেই একথা বলেন।
এতে
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ
কামাল লোহানী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার
হোসেন। সাংবাদিক-গবেষক শ ম ফুয়াদের
উপস্থাপিত প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশ নেন চ্যানেল আই’র প্রধান
বার্তা সম্পাদক শাহ আলমগীর, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আব্দুল জলিল ভূইয়া, সাংবাদিক, কবি ও লেখক আবু
হাসান শাহরিয়ার, দৈনিক যুগান্তরের বিশেষ সংবাদদাতা পীর হাবিবুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের
শিক্ষক রুবাইয়াৎ
ফেরদৌস। বর্তমান সংলাপের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সারফুল ইসলাম মাহমুদ সগীরের সভাপতিত্বে এতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক তথ্যসচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ ও বর্তমান সংলাপের
নিয়মিত লেখক মোহনগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের বাংলা
বিভাগের অধ্যাপক খালেদ মতিন। মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছিল :
আজকের
তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে সংবাদমাধ্যম একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নে
ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। আশার কথা, দেশে সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় থাকার কারণেই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সরকার ও বিরোধীদলের কর্মকান্ডের
বিস্তারিত খবর স্থান পাচ্ছে, জনগণ সচেতন হচ্ছে।
তবে
ভোগ বিলাস, মিথ্যাচার এবং ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের যে প্রবণতা আজকের
সংবাদমাধ্যমে অনেককে পেয়ে বসেছে, তা থেকে মিডিয়া
জগৎকে উদ্ধার করতে না পারলে এ
জগৎ থেকে কল্যাণকর কিছু আশা করা।
বৃথা
হতে পারে। দেশের সাংবাদিকতা তথা সংবাদমাধ্যম জগতের এ পরিস্থিতির আরো
অবনতি হচ্ছে। মনে পড়ে শকুনকে মরা গরু খেতে দেখে মহাকবি কালীদাস বলেছিলেন, ‘নাই তাই খাইতেছস্, থাকলে পাইতি কই?’
মিথ্যাচারের
মধ্যে ডুবে থেকে দেশের সত্য প্রকাশ ও তথ্য জানার
অধিকারকে নিশ্চিত করার কথা বলা বাতুলতা মাত্র। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজকে জয় করা, নিজের
মধ্যে সত্যকে লালন করা। সাংবাদিক
নিজের মধ্যে সত্যকে ধারণ, পালন ও লালন করবেন,
নিজে নিজেকে সম্মান দেবেন এবং দেশ-জাতি ও সমাজের স্বার্থ
তথা মানবতাকে সবার উর্ধ্বে স্থান দেবেন-এই ছিল সম্পাদক
শেখ আবদুল হানিফ-এঁর লক্ষ্য। এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ
তরুণ-তরুণী নিয়ে এতটা বছর নিয়মিতভাবে পত্রিকাটি প্রকাশ করে তিনি যে উদাহরণ রেখে
গেলেন তা এক গবেষণার
বিষয়। পত্রিকাটির এই দীর্ঘ পথ
চলায় দেশবরেণ্য অনেক সাংবাদিক-সম্পাদক-বুদ্ধিজীবী-উদ্যোক্তা-শিল্পী-সাহিত্যিক এর লক্ষ্য উদ্দেশ্যের
সাথে একাত্মতা প্রকাশ ও সম্মাননা গ্রহণ
করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ আজ লোকান্তরিত হলেও
তাঁদের একাত্মতা পত্রিকাটির সাথে জড়িত সকলের জন্য আজও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। ৫ শ্রাবণ ১৪২৬,
২০ জুলাই ২০১৯ তারিখে শেখ আবদুল হানিফ-এঁর লোকান্তরিত হওয়া উপলক্ষে দেশবরেণ্য কয়েকজন গুণী মানুষের একাত্মতার কথা এখানে তুলে ধরছি
‘বিশ্বমানবতার
সেবায় সংবাদপত্রের ভূমিকা সব সময় অগ্রগণ্য।
তাই সংবাদপত্রকে অবশ্যই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে
এবং অন্যায় অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে
কথা বলতে হবে। সৃজনশীল ও আত্মিক সেবা
সহায়ক বর্তমান সংলাপ-এর গভীর আত্মচেতনাবোধ
ও বিশ্লেষণ প্রশংসার দাবিদার’। -ওবায়েদ উল
হক, প্রাক্তন সম্পাদক, বাংলাদেশ অবজারভার।
‘বর্তমান
সংলাপ-এর হেডিংগুলো এত
সাহসী এবং প্রত্যয়ী যে এখনও এই
কাগজটি টিকে আছে কী করে তা
আমার একটু ভাবতে ইচ্ছে করে। কারণ সত্য কথা বলতে পারাটা বিপদজনক এখনকার পৃথিবীতে। এইভাবে সত্য বলার মতো কোনো পত্রিকা এখনও পর্যন্ত আমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে দেখেনি’ – কামাল লোহানী, প্রবীণ সাংবাদিক।
‘যে
মূহুর্তে দেশে সত্য কথা বলা যায় না, যারা ব্যবসা করে রাজনীতির নামে তাদের নামে কথা বলা যায় না, বর্তমান সংলাপ তাদের বিরুদ্ধে এত শক্ত কথা
বলল কী করে, এত
সাহস তারা পেল কোথায় ? বর্তমান সংলাপ ঘেঁটে আমি দেখলাম নিজে যদি সৎ থাকা যায়, কেউ
নিজে যদি ধর্মটাকে সঠিকভাবে পালন করে এবং ধর্মটাকে যদি মানে, তাহলে সত্যি কথা বলা যায়। বর্তমান সংলাপ এভাবেই করেছে বলে আমার বিশ্বাস। – আব্দুল জলিল ভূইয়া, সাবেক সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন’।
‘হাক্কানী
মিশন বাংলাদেশের মুখপত্র ‘বর্তমান সংলাপ’ এর প্রধান শ্লোগান
‘আমরা নিরপেক্ষ নই-সত্যের পক্ষে’। -এই কথা
বলার দুঃসাহস আমাদের সমাজে বিরল। নিরপেক্ষতার ভান করে আমরা বিভিন্ন সময় অনেক মিথ্যা ও অসত্য প্রচার
হয় জেনেও চুপ থাকি। সত্য দিয়েই মিথ্যাকে মোকাবেলা করতে হবে’।
-আ
ক ম মোজাম্মেল হক,
মাননীয় মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাংবাদিকতার আদর্শিক ধারাটি সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে বর্তমান সংলাপ এর উদ্যোগে জাতীয়
প্রেসক্লাব, পিআইবি সেমিনার কক্ষসহ দেশের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন প্রেসক্লাবে ‘সাংবাকিতায় মিথ্যাচারিতার প্রভাব’ শিরোনামে অনেকগুলো আলোচনা সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বর্তমান সংলাপ-এর এ সকল
কাজের মূলে ছিলেন এর নিভৃতচারী সম্পাদক
শেখ আবদুল হানিফ। লোকান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এক নতুন ভুবনে
প্রবেশ করলেন। যেখান থেকে তাঁর চিন্তা-চেতনা দেশ ও জাতির কল্যাণে
আরও বহু গুণে হবে। কিভাবে উৎসারিত হবে তাঁর ভক্ত-আশেকানদের মাঝে সেটা তাদের যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করতে হবে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সংলাপ॥
ভাষা সংগ্রামী ও মহান স্বাধীনতা
সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ এঁর অগ্রহায়ণী কবিতা থেকে পাঠ ও আলোচনা ২০
অগ্রহায়ণ ১৪২৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২০
সন্ধ্যায় সরাইলের কালীকচ্ছের শেখাবাদ ভবনের অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ গণগ্রন্থাগারে অনুষ্টিত হয়। অনুষ্ঠানে তাঁর ‘অগ্রহায়ণ আবার হোক বাঙালির নতুন বছর’ এই কবিতায় উৎসারিত
বক্তব্যের আলোকে অগ্রহায়ণ মাস থেকে দেশের আর্থিক বছর চালুর দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানে বলা হয়, প্রাচীনকালে বাঙালির প্রথম মাস অগ্রহায়ণই ছিল। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সুবিধার্থে
বৈশাখ মাসকে প্রথম মাস এবং ইংরেজ আমলে জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত অর্থ বছর চালু হয়েছিল। বাঙালির অর্থনৈতিক অবস্থাকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রকৃতি-পরিবেশের
ভিত্তিতে জোরদারের লক্ষ্যে অগ্রহায়ণ মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সাধারণ
মানুষের কাছে তুলে ধরার আহবান জানানো হয়। সরাইল ইতিহাস পরিষদের উদ্যোগে এবং সংগঠনের সভাপতি শাহ শেখ মজলিশ ফুয়াদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সরাইল সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল। শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী মোঃ
আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও সরাইল কলেজের
দ্বিতীয় ব্যাচের কৃতী ছাত্র ফজলুল হক মৃধা, আওয়ামী
লীগ নেতা হাজী মুজিবুর রহমান, শাহবাজপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ঠাকুর মেজবাহউদ্দিন মিজান, আবু আহমেদ মৃধা ও মাসিক সূর্যশপথ
পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক কবি আবুল কাশেম তালুকদার। আলোচনায় অংশ নেন ইসলামপুর কাজী শফিকুল শফিকুল ইসলাম কলেজের সহকারী অধ্যাপক আহমেদুর রহমান বিনকাশ, ইতিহাস পরিষদের সহসভাপতি ও অরুয়াইল আবদুস
সাত্তার ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কাওসার আলম বাবুল। বাংলার অগ্রহায়ণের ওপর স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন ফজলুল হক মৃধা। হেমন্তকালের
ওপর লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন তোবারক হোসেন। অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ এঁর ‘আমি এক নতুন অগ্রহায়ণ
চাই’ কবিতাটি আবৃত্তি
করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নেতা মোঃ
শরীফ উদ্দিন এবং স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী খোকন সেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শেখ মোতাহের হোসেন, বেনু চন্দ্র দেব, অ্যাডভোকেট নূরে আলম মৃধা, মোঃ মোশারারফ হোসেন, মোশতাক আহমদ টিটু ও কাজী ওয়াজউদ্দিন।
অনুষ্ঠানে
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক আশীর্বাদপুস্ট ও
সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ প্রতিষ্ঠিত হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ ও সাপ্তাহিক বর্তমান
কর্তৃক ‘অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের মাস ধরে হাক্কানী বর্ষ-১০ উপলক্ষে প্রকাশিত
ক্যালেন্ডারের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
অধ্যক্ষ
মৃধা আহমাদুল কামাল তার বক্তৃতা অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ কর্তৃক ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে (১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দ) নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে লেখা ‘হে আজাদী’ কবিতা
থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, স্যার আজীবন আপাদমস্তক দেশীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিলেন এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করে গেছেন। তিনি অগ্রহায়ণ মাস থেকে দেশের নতুন আর্থিক বছর চালু করার দাবি জানান। ঠাকুর মেজবাহউদ্দিন এই দাবির প্রতি
একাত্মতা ঘোষণা করেন। আবুল কাশেম তালুকদার বলেন, অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ স্যার ছিলেন একজন মহাসাধক, শিশুর মতো সরলপ্রাণের মানুষ কিন্তু অত্যন্ত সাহসী।
কাওছার আলম বাবুল কবিতার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানান। অনুষ্ঠানের সমাপনী পর্বে অতিথিদের আপ্যায়নে অগ্রহায়ণ মাসের পিঠা পরিবেশন করা হয়।
মোস্তাক আহাম্মদ ॥ আমার ছেলেবেলার স্মৃতি বলতেই মনে পড়ে
ছেলেবেলার হেমন্তকাল। শৈশব-কৈশোরে হেমন্তকে উপভোগ করতাম সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন
স্বাদে। সেই হেমন্ত এখন সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণ ছাড়া আর কিছুমাত্র কোথাও টিকে আছে
বলে আমার মনে হয় না । প্রাক-শৈশবে আমাদের পরিবার পুরাণবাড়ি ছেড়ে গ্রামের উত্তর দিকে
নতুন বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে থাকে। শুকনো মৌসুমে চারদিকে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এবং
বর্ষায় পানি আর পানি। শরতের শেষদিকে বর্ষার জল নামতে শুরু করত। বাড়ির চারদিকে মাছের
কোলাহলে রাতে ঘুমানো দায়। কৈয়াজাল, বড়শি, বড়া (‘কাইনুলি’ নামক বাঁশ জাতীয় ঘাস একহাত
পরিমাণ করে কেঁটে তাতে সূতা-বড়শি বাঁধা হত। কাইনুলির ভিতরটা বাঁশের মতো ফাঁপা হওয়ায়
ভেসে থাকত। ফলে জমিতে বেশি পানি থাকলেও জলজ আগাছার ফাঁকে কেঁচো বা বৈচা মাছের টোপ গেঁথে
পাতা যেত ।) ছিটকি পেতে মাছের নেশায় মত্ত থাকতাম। জমির পানি নেমে যাওয়ার সময়টাতে জালে
এতবেশি কৈ মাছ লাগত যে, মাছ খুলতে খুলতে হাতে ঘাঁ হয়ে যেতো। ভেষজ ঔষধ হিসেবে মেহেদিপাতা বেঁটে প্রলেপ দিতাম
হাতে। আমাদের মেছোগ্রুপে আমি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম। অন্য সবাই আমার চেয়ে কমপক্ষে
পাঁচ বছরের বড় ছিল। তাই আমি তাদের আদর-স্নেহেই থাকতাম। ওরা এতই দুর্দান্ত ছিল যে, তাদের
মধুরতম অত্যাচারে জননী জন্মভূমি অতিষ্ট হয়ে ওঠেছিল। ফলে যৌবনে পদার্পনের পূর্বেই তাদেরকে
বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। কেউ সামরিক বাহিনীতে, কেউ শহরে ছোটখাট চাকুরি নিয়ে, আর কেউ দাড়িগোঁফ গজানোর আগেই প্রবাসে পাড়ি জমায়। জাল,
বড়শি পাহারা দিতে রাতে নৌকায় ঘুমাত ওরা। মাঝেমাঝে আমিও সঙ্গী হতাম। ঘুম কীসের! নৌকায়
আনন্দের নহর বয়ে যেতো। কত রকমারি বিস্কুট, মুরালি, মনাক্কা, গজা খেয়েছি তার হিসেব নেই।
কখনো কখনো গরম গরম গুড়ের জিলাপি আনত ওরা। নৌকায় শুয়ে কার্তিক মাসের পূর্ণিমার চাঁদটা
একটু বেশি সোনালি আর বড় মনে হত। কখনো আবার তারাদের ছুটাছুটিও চোখে পরত। তখনও ভূগোলের
জ্ঞানার্জন হয় নি; ‘উল্কা’ বিষয়টা জানতাম না। তাই কিছুটা ভয়ও পেতাম।
হেমন্ত আমার মনে অন্যভাবেও আনন্দ জাগাত। প্রায় পাঁচ/ছয়
মাস পর আমরা স্বাধীন হয়ে যেতাম; নৌকার কাজ শেষ। গোপাট(নিচু সড়ক বা পায়ে হাঁটার কিছুটা
প্রশস্থ পথ) শুকিয়ে যেতো। খালগুলোতে সাঁকো বাঁধা হত। স্কুলে যেতে বাঁধা নেই, বাঁধা
নেই পাড়াময় ঘুরে বেড়াতে। বাড়ির পাশের চারাজমির নরম মাটিতে টেমডাং (ডাংগুটি), গোল্লাছুট,
হাডুডু, কানামাছি খেলা জমে উঠত। মাছেরা ততদিনে খালে আর বিলে আটকে গেছে। যাদের বুদ্ধি
বেশি তারাই চাঁচের বেড় পরার আগে বিল পেরিয়ে বুড়ি নদীতে মিশে গেছে। বিলগুলো ইজারা দেয়া
থাকতো। ফলে আমরা স্বাধীনভাবে ক’দিন মাছ ধরতে
পারতাম না। তবে খাল, ছোট নালা বা বিলের পাশের ছোট ছোট গর্তের মত জায়গা থেকেই অনেক মাছ
ধরে নিয়ে আসতাম।
ভাটি এলাকায় বাউয়া ধান(বোনা আমন) ফলত প্রচুর। চৈত্র-বৈশাখ
মাসে বৃষ্টি হলে চার চাষে জমিতে আমন ধানের বীজ বপন করা হত। সার-গোবর লাগত না। চারা
একটু বড় হলে মাটি নরম করতে এবং আগাছা দমন করতে আচড়া দেয়া হত। এছাড়া আর বিশেষ কোনো যত
নেয়া হত না। তবে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস পর্যন্ত জোয়ার না আসলে গরুর ঘাসের জন্য কিছু জমিতে
নিড়ানি পড়ত। বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ১০/১২ ফুট পর্যন্ত বেড়ে উঠত ধানগাছ। তবে
বেশি বাতাস বইলে ধানগাছগুলোতে কচুঁরিপানা সহ অন্যান্য ভাসমান আগাছা উঠে যেতো। এগুলোকে
আঞ্চলিক ভাষায় বলত ‘খাউড়’। সময় মত এসব পরিস্কার না করলে ধানগাছ নষ্ট হয়ে যেত। ভাদ্র
মাসে ধানগাছগুলো জটাপাকিয়ে (বুরবান্ধা) গেলে আর ভয় থাকত না। বর্ষার জলে বয়ে আনা উর্বর
পলিমাটির নির্যাস শোষন করে ধানগাছ গর্ভবতী হত আশ্বিনে। তাই তো লোকে ধাঁ ধাঁ বলত, ‘ছ’মাসের
কন্যা ন’মাসের গর্ভবতী।’আর কবি সুফিয়া কামাল তাঁর ‘হেমন্ত’ কবিতায় লিখেছেন-
“সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?”
হেমন্তে যতদূর চোখ যায় শুধু সোনালি ধান। সোনালি ফসলের
সম্ভার বয়ে নিয়ে আসত বলে আদিকালে অগ্রহায়ণ দিয়েই নতুন বছর গণনা শুরু হত। আমি বিস্তীর্ণ
সোনালি ধানের মাঠ দেখে বিস্মিত হয়ে যেতাম। কোনো জমির আইল দেখা যেতো না। কিন্তু ধান
কাটার আগেই নিজের জমি সনাক্ত করে ছিটা ফসল(মটর, কলাই, মসুরি ইত্যাদি) বপন, পাকাধান
নিয়ে অন্যের জমিতে পড়ে থাকা ১০/১২ ফুট লম্বা ধানগাছ সনাক্ত করে ধানকাটার ব্যাপারগুলো
আমাকে আরো বিস্মিত করে দিত। ধানকাটার শ্রমিক আসত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে। আমাদের
ধানকাটতে হত না। তারপরও জমিতে নামতাম। কামলাদের পেছনে পেছনে থেকে হাতফসকে বেরিয়ে যাওয়া
বা কেটে পরা ধানের শীষ কুঁড়াতাম। শীষগুলো কাটার জন্য আমরা শামুকের খোল ব্যবহার করতাম।
স্কুলে যাওয়ার পথেও এই কাজটা করতাম। অন্যেরা লুঙ্গি পরলেও দৈহিক আকৃতিতে ছোটখাটো বালক
হিসেবে আমি পরতাম ইংলিশপ্যান্ট। ধান কুঁড়াতে কুড়াঁতে দুই পকেট ভরে ‘তুলারমা’ দাদীর
কাছে চলে যেতাম। বুড়ি অসম্ভব রকমের সুস্বাদু মুড়ি ভাঁজতেন। বিক্রি করতেন ধানের বিনিময়ে।
যতটুকু ধান ততটুকু মুড়ি। তবে কখনো আমাদেরকে ঠকাতেন না। দুই পকেট ভরে গেলে হাতে কতকগুলো
দিয়ে বলতেন, ‘যা এখন ইচ্ছামত খাইতে খাইতে যা।’
স্কুলে যাওয়ার পথে গন্ধরাজ, শিউলি, কামিনী, দেবকাঞ্চন,
হিমঝুরি, ছাতিম, রাজঅশোকসহ নাম না জানা শতশত ফুলের সৌরভে আর সৌন্দর্যে মন ভরে উঠত।
কামরাঙা, চালতা, আমলকি, ডালিম, বেতফল খেয়েছি আমরা সেকালের হেমন্তে।
বীজতলায় বোরোধানের বীজ বপন করায় হাঁসগুলো খোয়াড়ে আটকে
যেতো। ফলে শামুক কুঁড়িয়ে আনতে হত কিছুদিন। বার্ষিক পরীক্ষার চাপ থাকলেও মাছ আর পাখি
শিকারের নেশাটা ছাড়তে পারতাম না। কানাবক, ধবলবক, হলুদ ঠোঁটের নলবক, পানকৌড়ি, বাড়ুই,
বালিহাঁস, মাছরাঙা কোনোটাই বাদ পড়ত না। এ কাজটা করতাম আব্বার চোখের আড়ালে। তখন ভোররাতে
ওঠে পড়া তৈরি করার অভ্যাস ছিল। ফজরের আযানের ঘণ্টাদেড়েক আগেই ওঠে সশব্দে পড়া শুরু করে
দিতাম। ফজরের আযান হলে আব্বা পুরাণবাড়ির পাশে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মসজিদে রোয়ানা দিতেন।
রাস্তাটা অন্তত দশ মিনিটের। নামাজ পড়ে কোরআন তেলওয়াত করতেন। বাড়ি ফিরতে মোটামুটি বেলা
হয়ে যেতো। ইতোমধ্যে আমার শিকারের কাজও শেষ। হাত-মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে যেতাম।
মাঝেমাঝে পড়ার বহর দেখাতে পাখি তাড়ানোর উসিলায় জমির আইলে
বইখাতা নিয়ে বসে যেতাম। তবে পড়া একবারে মন্দ হত না। নাড়া, খড়কুটা আর শুকনো কচুরিপানা
দিয়ে একটি আস্তানাও গেড়ে নিতাম। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো বলে অগ্রহায়ণের শেষ দিকে
আমরা পুরোপুরি স্বাধীন থাকতাম। আব্বা-আম্মা বেড়াতে পাঠাতে চাইলেও নিজগ্রামের এত আনন্দের
ফোয়ারা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতাম না। ভাটি এলাকায় হেমন্তে সব্জির অভাব থাকত। তথাপি, পেঁপে,
কাঁচকলা, আলুর মত বারমাসি সব্জির সাথে কচু, কচুমূখী, চুপড়িআলু, একধরণের বড়শিম, পাকা
চালকুমড়া, মিষ্টকুমড়া থাকত কোনো কোনো বাড়িতে। টক রান্না করত জলপাই, কামরাঙ্গা, তেঁতুল
মেষ্টা(চকুর) আর চালতা দিয়ে। তবে অধিকাংশ ঘরে শুধু মাছ দিয়েই মাছের কয়েক পদ রান্না
করত। ফুফুরা এবং বড়বোনেরা বেড়াতে আসতেন। তখন ভাঁপা, পুলি, পোয়া, পাক্কন, চিতুই ইত্যাদি
নানারকম পিঠাপুলির আয়োজন হত। মেড়াপিঠা তৈরির সময় জমে উঠত ‘গুল্লোপিঠা পেটে গেল’ যুক্তির
মধ্যে চুক্তি আর চুক্তির মধ্যে ব্যাঙ এর মত অনেক মজার মজার গল্প।
এত আনন্দের মাঝেও হেমন্ত কিছু দুঃখ বয়ে আনত। ‘মরা কার্তিক’
এ টানাটানিতে অনেকের ঘরেই ভাত থাকত না। কার্তিকের পঁচাপানি ওলাওঠা, মাম্পস্, সর্দিকাঁসি
বয়ে আনত কোনো কোনো এলাকায়। কলেরার প্রকোপ কখনো কখনো কবরস্থানেকে সাদা করে দিত। চাঁদনি
রাতে কবরস্থানের দিকে তাকলে ভিতরটা হু হু করে উঠত। আর অমাবশ্যার রাতে শুকনো বিলের দিকে
তাকালে চোখে পড়ত জলন্ত আগুন (আসলে আলেয়ার আলো); যা যমআগুন হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ সময়
আম্মা খুবই সতর্ক থাকতেন। মাছ ধরা, মাছ খাওয়া নিষেধ থাকত। আমার উপর নিষেজ্ঞা থাকত বেশি;
বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। মান্দারপুরের খনকার এসে দু’তিন রাত মোটাগলায় ডাক ছাড়তেন
যেন, ওলাবিবি পালিয়ে যায়। খনকারকে সবাই মোটা হাদিয়া (প্রতিঘর থেকে কমপক্ষে আড়াই সের
চাল) দিয়ে বিদায় করতেন। গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ, বাদলা, তড়কা দেখা দিত। মারা যেতো অনেক
পশু। ঘোষেরা গ্রামেগ্রামে ঘুরতেন। ভারেঙ্গার মাথায় একটা ব্যাগ ঝুলানো থাকত তাদের। ব্যাগে
অনেক যন্ত্রপাতি থাকত। ‘অও……ও…..ও…..’ ডাক তুলে তারা পাড়াবেড়াতো। গরুকে শুইয়ে
লোহার কাঠি-খুন্তা গরম করে খুর, গলা, দাঁতের গোড়ায় কী সব সেঁক ট্যাক দিত আর বানিয়ে
বানিয়ে ছড়া কাটত।
হেমন্তের কিছু অপকারিতা বা প্রতিকূলতা আছে। কিন্তু শিশিরভেজা
মিষ্টি সকাল, সোনারোদের সোনালি বিকেল আর কোন ঋতুতে পাবেন! তাই তো বিশ্বকবি তার ‘নৈবদ্যে
স্তব্ধতা’ কবিতায় লিখেছেনঃ
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
শস্যশ্যামলা, সুজলা সুফলা আমদের এ দেশে আছে ছয়টি ঋতু।
তাই তো ষড়ঋতুর দেশ বলা হয় আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে। কিন্তু প্রকৃতির উপর আমাদের নিষ্ঠুর
অত্যাচারে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আজ জীবন ও প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যেই
হারিয়ে যেতে বসেছে কিছু ঋতু; যার মধ্যে প্রথমেই যেনো হেমন্তের বিদায় নেয়ার পালা।
সংলাপ ॥ চলে গেলেন বর্তমান সময়ের প্রথিতযশা
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার
মুনীরুজ্জামান। সাংবাদিক মহলে তিনি গভীর জ্ঞান আর বিশ্লেষণী দক্ষ সম্পাদক হিসেবে পরিচিত
ছিলেন। ২৪ নভেম্বর ২০২০, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৭ মঙ্গলবার সকাল ৭টা ২০মিনিটে রাজধানী মুগদা
জেনারেল হাসপাতালে তার ইন্তেকালের প্রচারিত হলে সাংবাদিক ও সুধী মহলে শোকের ছায়া নেমে
আসে। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে খন্দকার মুনীরুজ্জামান বিগত
২১ দিন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। করোনা থেকে তিনি সেরে উঠেছিলেন।
কিন্তু করোনা-পরবর্তী বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন। তার
স্ত্রী চিকিৎসক। খন্দকার মুনীরুজ্জামান ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
তার পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার রাণীদিয়া গ্রামে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মুদ্রণ (প্রিন্ট)
ও বৈদ্যুতিন (ইলেক্ট্রনিক) মাধ্যমসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন অঙ্গনে মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক
ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা এবং গণমানুষের পক্ষে তার বক্তব্য ও লেখালেখির জগতে তিনি একটি
বিশেষ স্থান তৈরি করেছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যয়নের সময় সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। একই সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক সংবাদে তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পরে ভারপ্রাপ্ত
সম্পাদক হন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (সিপিবি)’র ঢাকা জেলা কমিটির
সম্পাদক ছিলেন। খন্দকার মুনীরুজ্জামান সাংবাদিকতা ছাড়া ও কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, চিত্র,
সমালোচনা ও নিয়মিত কলাম লিখতেন। সমকালীন সাংবাদিকতায় গণমানুষের পক্ষে সদ্যপ্রয়াত খন্দকার
মুনীরুজ্জামানের ভূমিকা ও অবদান বর্তমান সংলাপ পরিচালনা পর্ষদ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
সাইমা,
মাস্কাট (ওমান) থেকে ॥ পৃথিবীর বিখ্যাত
সূফী সাধকদের অন্যতম সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব হযরত শাহ কলন্দর সূফী খাজা শেখ আবদুল হানিফ – অনুগ্রহবশত তাঁর নিকট বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আগত মানুষদের সাথে কথা বলার সময়,
একদিন এক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তির
সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে সমস্যা গ্রস্থ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যে করে এই বাণীটি উচ্চারণ
করেছিলেন। নিজ সমস্যা নিজের চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারে না। কে কি করছে
– নিজেই ভালো করে জানেন। শরীরের কোন জায়গায় ব্যথা আছে? ডাক্তারের চেয়ে ব্যক্তিটি ভালো করে জানেন ।
ব্যথার
উৎস খুঁজতে হলে নিজের সাথে শরীর এরং মনের নিবিঢ় সর্ম্পক থাকা প্রয়োজন। শরীরের যদি উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস থাকে এবং দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তবে একসময় শরীরের ব্যথা থাকলেও, ইহা অনুভব শক্তিতে উপলদ্ধিও সৃষ্টি করে না। যেমন- হাসপাতালে ডাক্তার যখন রোগীর সার্জারী করেন, তখন নিদিষ্ট স্থানে চেতনানাশক ইনজেকশান দিকে দিয়ে স্থানটি অনুভূতিহীন করেন এবং রোগী সার্জারীকৃত স্থানের ব্যথা তাৎক্ষনিক উপলদ্ধি করতে পারেন না।
আলোচ্যক্ষেত্রে
বানীটি সমস্যাগ্রস্থ এবং সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে সূফী সাধকের অনুগ্রহ। সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ সাধারণ মানুষকে খুবই ভালোবাসতেন এবং ছোটদের ভীষণ স্নেহ করতেন। মানুষ এইসব বিষয় জানেন। সমস্যাগ্রস্থ লোকটিকে সূফী সাধক ব্যাখা করতে চেয়েছিলেন – ঐ নিদিষ্ট অসুখটির
জন্য বিশেষ কোন ঔষধের
প্রয়োজন নাই। সমস্যাটি যেখানে আছে – ইহা উপলদ্ধি করে ব্যবস্থা নিলে আপনি থেকেই – ঐ লোকের অসুখটি
দূর হবে।
সমাজে
মানুষ দিন-রাত্রি ছুটছে। কোথায কি কাজে ছুটছে
– ছুটন্ত ব্যক্তিও জানে না। চলছে হাটে-বাজারে-অফিসে, কত যে কাজে! দিনের
পর দিন – মাসের পর মাস, এমনি
বছর বা যুগ যুগ
ধরে। চলার পথে শেষ নাই। আহ! কি অক্লান্ত পরিশ্রম।
দিনের সমাপনান্তে দুঃখ-দৃর্দশা ও দুর্বিষহ জীবন।
একটি মুহূর্তও মানুষ ব্যক্তিজীবনে অনুভব করে না – যে এই বিভীষিকাময়
মিথ্যা ধোকাবাজির জীবন থেকে বের হয়ে আসা নিজের জন্য অতি জরুরি।
কারণ
ব্যক্তি জীবনে কেউ অশান্তিতে ভুগলে সমাজ/দেশ/জাতি কারো কিছু আসে যায় না। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়
ব্যক্তিজীবনে নিজের। সুতরাং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যামে নিজের মধ্যে একক শক্তি অর্জন করা দরকার এবং এই একক শক্তি
অনুশীলন ও চর্চা করতে
হবে সারাটি জীবন। এক ছেড়ে যখনই
দুই এর মধ্যে পা
রাখা হবে- ঠিক তখনই ভয়াবহ ধ্বংস আরম্ভ হবে। দুর্বলতা যখন চরম -ভাঙ্গন বা ধ্বংস তখন
অবশ্যই। দুর্বলতা তখনই যখন নিজের উপর নিজের বিশ্বাস অর্থাৎ আত্ববিশ্বাস থাকে না। ৯০% মুসলিম জনগোষ্টির দেশে কতটি মানুষের আত্ববিশ্বাস আছে অর্থ্যাৎ নিজকে নিজে বিশ্বাস করেন ? শুধু একে অন্যের কথা শুনে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। যেখানে ছুটাছুটি বা দৌড়াদৌড়ি থাকে
– সেখান মানুষ স্থির নয়। যে মানুষ স্থির
নয়- সে নিজের উপর
নিজের নিয়ন্ত্রণ নাই। যার
নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রন নাই সে বেহুশ। বেহুশ
লোক বেফাশ কথাবার্তা বলে। বেহুশ লোককে বিশ্বাস করা যায় না এবং বেহুশ
লোকদের সাখে চলাফেরা করা বিপদজ্জনক।
বেহুশ
লোকের জ্ঞান-বুদ্ধি ঠিকমতো কাজ করছে না। জ্ঞান-বিবেক ঠিকমতো কাজ না করলে – তার
শুভ অনুভূতির সৃষ্টি হয় না। কোন
ভালো অনুভূতির সৃষ্টি হয় না – উপলদ্ধির
সৃষ্টি হয় না – সোজা
পথে চলন হবে কিভাবে ? সমাজের মানুষ বাঁকা পথে চলতেই পছন্দ করে। কারণ ৯০% মুসলিম জনগোষ্ঠির দশে প্রতিটি খাবারে ভেজাল। মিথ্যার দাপটে দেশ-জাতি নিদারুন অসহায়। মানুষ এসব জেনেও নিজকে রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। কারণ তার উপলদ্ধি নাই। সে ভেজাল বা
মিথ্যার জগতে বাস করে – বেহুশ অবস্থায়। কথায় আছে, “চোরে না শুনে ধর্মের
কাহিনী”। আমাদের রাষ্ট্র
ধর্ম ইসলাম। কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম আমাদেরকে ভেজাল খাবার থেকে রক্ষা করতে পারছে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ধর্ম আমার ব্যক্তি জীবনে কাজে আসছে না। যে লোকটির নিজের
উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নাই – তার অবস্থা ঠিক একটি ভাঙ্গা ও অকোজা ট্রাফিক
লাইটের মতো। নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নাই – এমন লোকটি সম্পূর্ণ অপদার্থ এবং অকেজো ও দুর্বল। তার
অনুভূতি এবং উপলদ্ধি কিছুই নাই। সে এমন দুর্বল
তার শরীরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে
– সে বুঝতে পারছে না। কিডনীর ৭৫% ডেমেজ হওয়ার পর সে অসুস্থ
অনুভব করে। হার্ট ৭০% ক্ষতি হওয়য়ার পর সে অসুস্থ
অনুভব করে। একইভাবে লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গসমূহ। এসব ক্ষতি হওয়ার পর কি করার
থাকে? দূর্বিসহসহ ভোগান্তির জীবন। একজন মানুষ যখন তার ঈশরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে – ঠিক তখনই তার দূর্বিসহ ও দুঃখময় জীবন
আরম্ভ হয়। অর্থাৎ আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থাটিই হলো জাহান্নাম – তথা দুঃখময় দূর্বিষহ জীবন। সুতরাং কোন অবস্থাতেই আল্লাহর নিকট থেকে মূহুর্ত সময়ের জন্য হলেও নিজকে বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না। এক আল্লাহর সাথে
সার্বক্ষনিক যুক্ত থাকা আবশ্যক। আজকে এখানে এক আল্লাহ পেলাম-আগামীকাল ওখানে অন্য আল্লাহ। এভাবে চলা যায় না। মাদ্রাসার হুজুরেরা বলেন, আল্লাহর নাম ৯৯টি। ঠিক আছে। কিন্তু মূল আল্লাহ তো একজনই। যেহেতু
আমি একজনই – সেই কারণে আল্লাহ একজনই। বহুর মধ্যে কখনো এক থাকতে পারে
না। একের মধ্যে বহু হতে পারে। এই বিষয়ে কারো
আপত্তি নাই। সুতরাং এক আল্লাহর সাথে
যুক্ত থাকতে হবে। ইহাই জীবনের লক্ষ্য ও জীবনের উপলদ্ধি
।
পবিত্র
গ্রন্থ বাইবেল-এ প্রভু যীশু
বা ঈসা পয়গম্বর বলেছেন,
“আমার সাথে যুক্ত থাকো। গাছের ডালা-পালার মতো আমার সাথে নিবিঢ়ভাবে যুক্ত থাকো। আমার সাথে যুক্ত না থাকলে, তোমরা
মৃত গাছের ডালা-পালার মতো হয়ে
পড়বে এবং আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।”
বাবা
লোকনাথ ভ্রহ্মচারী তাঁর গুরুর হুকুমে হিমালয়ের ঝর্ণা ধারায় এক পাথর খন্ডে
একনিষ্ট এবং নিবিঢ়ভাবে গুরুসহ ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। বাবা লোকনাথ, তাঁর ভ্রমন বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন, তাঁর জীবনে তিনি ৩ জন ব্রক্ষচারী
(অর্থাৎ ৩ জন সিদ্ধ
পুরুষ/আদম/মৌলভী) পেয়েছিলেন। একজন আফগানিস্তনে। একজন মক্কায় (আব্দুল গফুর) এবং বানারসের সাধক তৈলঙ্গ স্বামী।
উপমহাদেশের
উজ্জ্বল তারকা স্বামী বিবেকানন্দ লাল পাগড়ি এবং লাল পোষাক পরিহিত অবস্থায় গভীর ধ্যান মগ্ন ছবি আজও তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বৌদ্ধরা কঠোরভাবে গুরু ধ্যান সাধনা করে। তাঁদের মেডিটেশন সেন্টারই আছে।
এসব
ধ্যান কেন করা হয় ? কারণ বেশী কিছু নয়। নিজ গুরুর সাথে যুক্ত থেকে নিজেকে জানা এবং সুস্থ একটি উপলদ্ধির সৃষ্টি করা। যিঁনি নিজকে উপলদ্ধি করতে পারেন- তিনি যা বলেন – তাই
হয় । অন্যরা কিছু
বললে হয়
না। পার্থক্য এখানে। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত), “যে নিজেকে চিনেছে
– সে আল্লাহ-কে চিনেছে”।
আউলিয়া/গাউস/পীর/মাশায়েক সকলেই বলেছেন, নিজকে চিনো। নিজ গুরুর হুকুম পালন ব্যতীত কোনদিন নিজকে চেনা সম্ভব নয়। নিজ গুরুর আদেশ-উপদেশ-নিষেধ মানতেই হবে। ইহা বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে গুরু সামনে উপস্থিত না থাকলে, গুরুকে
স্মরণ করা এবং গুরুর হুকুমসমূহ পালন করা একান্তই বাধ্যতামূলক।
Socrates
তাঁর ছাত্রদের বার বার নির্দেশ দিয়েছেন, “Knwo yourself” আমার পিতা আমাকে বার বার বলেছেন, “যতই নিজকে চিনবে – ততই আল্লাহর নিকটে যাবে”। অর্থাৎ নিজকে
ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে পারবো। নিজকে উপলদ্ধি করার জন্যই সকল আয়োজন। যারা নিজেকে চিনেছেন, তাঁরা সকলেই এক গুরুর নিকট
স্থির ছিলেন এবং একনিষ্ঠভাবে একক গুরুর হুকুম মোতাবেক কাজ করেছেন। একের মধ্যে তাঁরা সকলেই বহু এবং বিরাজমান সর্বত্রই। তাঁরা কোথাও দৌঁড়াদৌড়ি করে না।
ইবলিশ
অতি চালাকির কারণে নিজকে উপলদ্ধি করতে পারে নাই অথবা বা নিজকে বুঝতে
পারে নাই। সারা জীবন এতো সিজদা করেছে – আদমকে সিজদা দিলে, এমন কিইবা হতো? মানুষ তো ভুলবশতঃ সিজদা
করে ফেলে। আল্লাহ যখন সিজদা দিতে হুকুম দিলেন, তখন তো দ্বিতীয় অজুহাতেই
চলে না। আল্লার হুকুমই স্বয়ং আল্লাহর প্রকাশ এবং সামনা সামনি উপস্থিতি। বিষয়টি অনুভব এবং উপলদ্ধি করতে না পারার কারণে
সে ইবলিশ বা মোকরোম।
উপলদ্ধি
জ্ঞান না থাকার কারণে
ইবলিশ আদমকে সিজদা করে নাই। অর্থাৎ অতি চালাক। আজও সমাজে প্রচুর মানুষ আছে -যারা আদমকে সিজদা করতে রাজি নয়। কারণ, তারা ইবলিশের চেয়েও অতি চালাক। অতি চালক না হয়ে, নিজকে
উপলদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয়া আবশ্যক। যাঁরা নিজকে চিনেছেন, তাঁরা সকলেই উপলদ্ধি জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। (চলবে)
শাহ্
সূফী ড. এমদাদুল হক
॥ আমরা নিজের বিচার নিজে করতে পারি না, কারণ সর্বক্ষণই অন্যের বিচার করতে ব্যস্ত থাকি। অন্যের বিচার করতে করতে নিজের বিচার নিজে করবার মতো সময়ই থাকে না আমাদের। তাই
নিজের বিচার নিজে করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে অন্যের বিচার না করা। রাত্রদিনে
আমরা পরধর্ম বিচার করি, পরনিন্দা-পরচর্চা করি, পরের উপর দোষারূপ করি। এসব পরচর্চা বন্ধ হলেই কেবল নিজের বিচার নিজে করার কাজটি শুরু করা যায়।
শান্তি
প্রতিষ্ঠার মূলনীতি হচ্ছে – সকল মানুষই আল্লাহর বৃহত্তম পরিবার। তাই অন্য কোন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে হেয় করার কোন সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই অন্যদের রক্ত
আমাদের রক্তের মত। অন্যদের মাল আমাদের মালের মত এবং অন্যদের
ইজ্জত-আবরু আমাদের ইজ্জত-আবরুর মত। ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি কিংবা কোন বাধ্য বাধকতা নেই। আমার জন্য আমার ধর্ম, তোমার জন্য তোমার ধর্ম। আমার ধর্মের
সাথে অন্যের ধর্মের তুলনা করা পাপ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম নয়, একই ধর্মের বিভিন্ন নাম। আল্লাহ, গড, ঈশ্বর, ভগবান ইত্যাদিও বিভিন্ন বিধাতার নাম নয়, একই বিধাতার বিভিন্ন নাম। একইভাবে – বাইবেল, কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ নয়। একই ধর্মের একই ধর্মগ্রন্থ। সমগ্র মানবজাতি একই আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহ এক, ধর্ম এক, ধর্মগ্রন্থ এক, নবী-রসুল এক। আমিও এক, দু’টি চোখ
দিয়ে আমি একই দেখি, দুটি কান দিয়ে একই শুনি, দুটি পা দিয়ে একই
দিকে চলি। তবু এত বিভাব কেন?
বিভাবের সৃষ্টি হয় চিন্তার বিভাব
থেকে। আমরা যদি চিন্তার বিভাবকে ‘এক’ – এ পরিণত করে
‘এক’ এবং অভিন্নতাকে দেখতে পারি তবেই পরচর্চা বন্ধ হবে এবং নিজের বিচার নিজে করতে পারবো।
অন্য
লোক কতটুকু ধার্মিক, অন্য লোকের কতটুকু গুরুভক্তি আছে তা বিচার্য বিষয়
নয়। অন্য লোকের বিয়াদ্দবির দিকে নজর না দিয়ে নিজের
আদব আছে কি-না সেদিকে
নজর দিলে আত্মোন্নতি হয়। অন্যদিকে, বন্ধ হয় ধর্মের নামে
দলাদলি ও তর্কাতর্কি। ধর্মের
নামে অধর্ম শুরু হয় পরচর্চা-পরনিন্দা
থেকে। এক ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে
তার দোষ অন্যদের নিকট প্রকাশ করলেই অধর্মের চর্চা শুরু হয়। কেউ পরিপূর্ণভাবে দোষমুক্ত নয়। মানুষের দোষ থাকতেই পারে। দোষ থাকলেও দোষের কথা ব্যক্তির অনুপস্থিতে বলা যাবে না। নিজের বিচার নিজে করার ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। তাই
কুরআন পরনিন্দা পাপের ব্যাপকতা বুঝাতে পরনিন্দাকে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণের সাথে তুলনা করেছে। কোন মানুষ মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করবে এটা যেমন কখনও চিন্তায় আসে না ঠিক তেমনি
পরের দোষ বা পরের বিচার
যেন কখনও নিজের চিন্তাজগতেও প্রবেশ না করে।
পৃথিবীর
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোন না কোন গুণ
রয়েছে। সৃষ্টি জগতে এমন একটা প্রাণীও নেই যার কোন গুণ নেই। মানুষ যা খুঁজে তারই
সন্ধান সে পায়। প্রশ্নটা
হচ্ছে আমরা কি খুঁজবো? যদি
কলঙ্ক খুঁজি তবে তা চাঁদেও পাওয়া
যাবে। কলঙ্ক না খুঁজে গুণ
খুঁজার চেষ্টা করলে প্রত্যেকের মধ্যেই তা-ও পাওয়া
যাবে। মানুষের দোষ না খোঁজে গুণ
খুঁজলেই মানুষের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে। তাহলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো এবং নিজের বিচার নিজে করার সময় পাবো।
‘নিজ’
হচ্ছে – আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া, স্মৃতি, হতাশা, সফলতা-ব্যর্থতা, আনন্দ-বেদনা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বপ্ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ভাল
লাগা ও খারাপ লাগা,
চিন্তা, কল্পনা, দিবাস্বপ্ন, আবেগ, লোভ, ক্রোধ ইত্যাদির সমষ্টি। নিজের বিচার নিজে করার অর্থ – নিজের মধ্যে এসব কিভাবে বিরাজ করছে সে সম্পর্কে পূর্ণ
সচেতনতা।
প্রশ্ন
হচ্ছে – নিজের বিচার নিজে করবো কিভাবে? আমার বিচার কি আমি করতে
পারি? তাহলে যে আমি আমার
বিচার করবে সে আমি কি
আমারই অর্ন্তভূক্ত? আমার মধ্যে আমার থেকে পৃথক এমন কোন আমি আছে কি যে আমি
আমার বিচার করবে? আমি কি সে আমিকে
চিনি? ধরা যাক্, রাতে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে, সকাল ৫ টায় ঘুম
থেকে উঠবো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠলাম না। তাহলে কোন্ আমি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে ৫ টায়
উঠবে, আর কোন্ আমি
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলো? আমার মধ্যে কতগুলো আমি আছে? আমি কি এক?
নিজেকে
এভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অনেকগুলো পরিবর্তনশীল আমির অস্তিত্ব উপলব্ধিতে আসে। বুঝা যায় যখন
যেখানে যে চরিত্রে অভিনয়
করা দরকার সে চরিত্রে মানুষ
অভিনয় করে মাত্র। প্রায় প্রতিটি মানুষই বহুরূপী। মালিকের কাছে যিনি ভৃত্যের অভিনয় করেন তিনিই ভৃত্যের কাছে মালিকের অভিনয় করেন। নিজের কাজের লোকের সামনে যিনি কর্কশ, মালিকের সামনে তিনিই কোমল। মানুষ ভুলে যায় কোন্টি তার আসল রূপ। নকল রূপের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে নিজেই আবার নিজেকে খুঁজে মরে। নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা অব্যাহত রাখলে দেখা যাবে অনেকগুলো পরিবর্তনশীল আমির মধ্যে একটা আমি আছে যার কোন পরিবর্তন হয় না। সেই
অপরিবর্তনীয় আমিই হচ্ছে ‘নিজ’ যে নিজের বিচার
করতে পারে।
‘নিজের
বিচার নিজে কর’ অর্থ হচ্ছে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা। নিজের চিন্তাপ্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে প্রতি মিনিটেই নিজের ভেতরে রূপের পরিবর্তন ঘটছে। প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার বার
রূপের পরিবর্তন ঘটে। এ বহুরূপীতার উপলব্ধি
থেকেই এক রূপে থেকে
‘এক’-কে জানার তৃষ্ণা
জাগ্রত হয়।
‘রাত্রদিনে’
অর্থাৎ সর্বক্ষণ। আমরা যদি
পানির গুণগত মানের পরিবর্তন ঘটিয়ে একে বাষ্পে পরিণত করতে চাই তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত তা বাষ্পে পরিণত
না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত একটানা একে
উত্তপ্ত করতে হবে। নিজের সুবিধামতো সময়ে মাঝে-মধ্যে উত্তপ্ত করলে রূপান্তর ঘটবে না। অন্যদিকে রাতের গুরুত্ব দিনের থেকে অধিক। তাই দিবানিশ বা দিনরাতে না
বলে, বলা হয়েছে ‘রাত্রদিনে’। নিজের বিচার
নিজে করার কর্মে রাতের গুরুত্ব দিনের চেয়ে বেশি মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, রাতে চারিপাশে একটা নীরবতা বিরাজ করে। চারপাশের নীরবতা ভেতরটাকে নীরব করতে প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয়ত, সারাদিন কাজ করে রাতে সব মানুষই বিশ্রাম
নেয়। রাতে আরামের ঘুমকে উপেক্ষা করে ভক্ত যখন গুরুর সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টায় রত থাকে তখন
এ প্রচেষ্টার মূল্যায়নও উঁচু স্তরের হয়। তাই সাধনার ক্ষেত্রে দিনের চেয়ে রাত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, রাত্রি জাগরণ মানুষের বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে ‘এক’ – এ পরিণত করতে
অধিক সহায়ক।
নিজেকে
বিচার করার প্রচেষ্টা রাত থেকেই শুরু করা উত্তম। প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার আগে দিনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করতে হবে। আজ সারাদিন কি
করেছি? কতবার মিথ্যা বলেছি? কতবার সত্য থেকে দূরে সরে গেছি? কতবার, কতরূপ নিজের মধ্যে প্রকট হয়েছে? এসব বিচারের উপযুক্ত সময় দিনের শেষে। দৈনন্দিন কর্মের বিচার করলে আজ কি কি
কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে মনে মনে তার একটা তালিকা তৈরী করা যায়। তাহলে আজকের অসমাপ্ত কাজগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী কাল তা সম্পন্ন করতে
সুবিধা হয়।
মানুষ
যা করে তাই পায়। প্রতিদিনের কর্ম তালিকার শীর্ষে যিনি গুরুর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা রাখেন গুরুও তাঁর তালিকায় সে ভক্তকে শীর্ষে
রাখেন।