প্রথম পাতা

‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি’ বাঙালির নববর্ষ ১৪২৮ ভাবনা

বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি।’

একজন খাঁটি বাঙালি কখনো মিথ্যা বলে না।

একজন খাঁটি বাঙালি একজন কুরআনিক মুসলিম।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদের পড়–য়ারা অনেকেই টাকা-পয়সার মোহে সমাজের সর্বস্তরে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিপনার কাজে লিপ্ত রয়েছে – এইসব বিভ্রান্তদের তালিকা তৈরি ও ভালমানুষ করার জন্য সমাজের সবাই এগিয়ে আসি।

বর্তমানে শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী আর সংস্কৃতির নামে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে। তাই প্রতিটি বাঙালির জীবনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ, লালন ও পালন করি।

সকল শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্ম গ্রামে। দেশকে সমৃদ্ধ করতে জন্মস্থান গ্রামের সাথে শহর-নগরের ব্যবধান  কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতদের করা ‘পলিটিক্স’ এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনীতি’ শব্দটির পরিবর্তে দিন বদলের পালায়  ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করি। জননীতি-অর্থাৎ শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগী, সৎ ও মুক্তচিন্তার যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে কাজের সুযোগ করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।

‘সত্য বলি, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, নিজে বাঁচি-দেশ ও জাতিকে বাঁচাই।’

ধৈর্যশীল হয়ে, অন্যের দোষ ক্ষমা করে আল্লাহ্র দরবারে ক্ষমা পাওয়ার প্রার্থী হই।

কর্ম ও চিন্তায় সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের পরিচয় দিই।

প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করি এবং আত্মিক উন্নতি করি।

ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন। তাই কর্ম করি সৃষ্টির সেবাতেই। সেই ফুল হই – যে ফুল প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু ঝরে যায় না। 

সত্যবাণী

ইসলাম জাগো! মুসলিম জাগো! আল্লাহ্ তোমার একমাত্র উপাস্য, কোরআন তোমার সেই ধর্মের, সেই উপাসনার মহাবাণী, – সত্য তোমার ভূষণ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তোমার লক্ষ্য, – তুমি জাগো! মুক্ত বিশ্বের বন্য শিশু তুমি, তোমায় পোষ মানায় কে? দুরন্ত চঞ্চলতা, দুর্দমনীয় বেগ, ছায়ানটের নৃত্য-রাগ তোমার রক্তে, তোমাকে থামায় কে? উষ্ণ তোমার খুন, মস্ত তোমার জিগর, দারাজ তোমার বিল, তোমাকে রুখে কে?  পাষাণ কবাট তোমার বক্ষ, লৌহ তোমার পঞ্জর, অজেয় তোমার বাহু – তোমায় মারে কে? জন্ম তোমার আরবের মহামরুতে, প্রাণ প্রতিষ্ঠা তোমার পর্বত গুহায়, উদাত্ত তোমার বিপুল বাণীর প্রথম উদ্বোধন ‘কোহ-ই তুরের’ নাঙ্গা শিখরে, – তুমি অমর, তুমি চির জাগ্রত। ‘আল্লাহু আকবর’ তোমার ওঙ্কার, আলি তোমার হুঙ্কার, তুমি অজেয়! বীর তুমি, তোমার চিরন্তন মুক্তি, শাশ্বত বন্ধনহীনতা, ‘আজাদীর’ কথা ভুলায় কে? তোমার অদম্য শক্তি, দুর্দমনীয় সাহস, তোমার বুকে খঞ্জর চালায় কে? ইসলাম ঘুমাইবার ধর্ম নয়, মুসলিম শির নত করিবার জাতি নয়। তোমার আদিম জন্মদিন হইতে তুমি বুক ফুলাইয়া, শির উচ্চ করিয়া দুর্লংঘ্য, মহা পর্বতের মত দাঁড়াইয়া আছ, তোমার গগনচুম্বী মিখরে আকাশ-ভরা তারার আলো, অর্ধচন্দ্রের প্রদীপ্ত প্রশান্তি জ্যোতি – তোমার সে মহাগৌরবের কথা বিশ্বে চির-মহিমান্বিত। মনে পড়ে কি, তোমার সেই রক্ত-পতাকা যাহা বিশ্বের সিংহদ্বারে উড়িয়াছিল, তোমার সেই শক্তি যাহা দুনিয়া মথিত আলোড়িত করিয়াছিল? বল বীর, বল আজ তোমার সে শক্তি কোথায়? বল ভীরু, তোমার সে প্রচন্ড উগ্র মহাশক্তিকে কে পদানত করিল? উত্তর দাও। তোমায় আমি আল্লার নামে আহবান করিতেছি, উত্তর দাও! তোমার অপমান কেহ কখনো করিতে পারে নাই, ইসলাম অবমাননা সহে নাই। তুমি সত্য, ইসলাম সত্য, তোমার-আমার বা ইসলামের অপমান যে সত্যের অপমান। তাহা যে সত্য করে, সে ভীরু – সে ক্ষুদ্র। যেদিন তুমি তোমার উদারবাণী মহাশিক্ষা ভুলিয়া স্বাধীনতার বদলে অধীনতার ছায়া মাড়াইতে গিয়াছ সেই দিনই তোমার শিরে মিথ্যা, দুশমনের ভীম প্রহরণ বাজিয়াছে। ইসলাম এক মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাহারো নিকট শির নোয়ায় না। তোমার চির-উচ্চ চির-অটল ঋজু সেই শির আনত করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তাই আজ তুমি আঘাত পাইয়াছ, তাই তোমার বক্ষে বজ্রবেদন, শক্তিশেল বাজিয়াছে। যদি আঘাতই খাইয়াছ, যদি আজ এমন করিয়া গভীর বেদনাই তোমার মর্মে বাজিয়াছে, যদি এই প্রথম অবমানিত হইয়াছ, তবে তোমার লাঞ্ছিত সত্য, ক্ষুব্ধ শক্তি আবার উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গের মত উদ্বেলিত হইয়া উঠুক। বল, ইসলাম ভিক্ষা করে না, যাঞা করে না। বল, দুর্বলতা আমাদের ধর্মে নাই। বল, আমাদের প্রাপ্য আমাদের মুক্তি আমরা নিজের শক্তিতে লাভ করিব!

… তোমার বাঁধে ভাঙ্গন ধরিয়াছে, তোমাকে ইহা হইতে রক্ষা পাইতে হইবে। তাই আজ আমরা আমাদের সারা বিশ্বের লাঞ্ছিত বিক্ষুব্ধ শক্তি লইয়া এই মুক্ত মহা-গগন-তলে দাঁড়াইয়া বলিতে চাই – ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’! এই মুক্ত গগনতল তোমার মহাতীর্থস্থান – আরাফাতের ময়দান অপেক্ষাও পবিত্র। এইখানে গৃহহীন পথহারা নিপীড়িত মুসলিম সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব পাইয়াছে, ঈদের দিনের মত পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়াছে, বুকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়াইয়া মুসলিম, আবার বল, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’। যদিও তুমি সর্বস্বহারা হও, কোথাও তোমার মাথা গুঁজিবার ঠাই না থাকে, কুছ পরোয়া নেই, তোমার মাথা নত করিও না। আবার সকলি পাইবে। মুসলিম হীন, এ ঘৃণার কথা শুনিবার পূর্বে কর্ণরন্ধ্রে সিসা ঢালিয়া বধির হইয়া যাও! তোমাদের এই ‘ইখওয়াৎ’কে কেন্দ্র করিয়া আমাদের অন্তরের সত্য স্বাধীন শক্তিকে যেন কোনদিন বিসর্জন না দিই। তোমার বীর ভাইগুলি ঐ যে তোমার দক্ষিণ পার্শ্বে ইসলামের এই শাশ্বত সত্য রক্ষার জন্য হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেছে, সেই শহীদায়েন নব্য তুর্কি-তরুণদের দেখ, আর গৌরবে তোমার বক্ষ ভরিয়া উঠুক। তাহাদের পানে তাকাও, তাহাদের অস্ত্র-ঝঞ্চনা শোনে – তাহাদের হুঙ্কারে তোমার হিম-শীতল রক্ত উষ্ণ হইয়া বহিয়া যাক তোমার শিরায় শিরায়। মেঘ-মুক্ত প্রাবৃট-মধ্যাহ্নের রক্ত ভাস্কর তোমার বিপুল ললাটের ভাস্কর রাজটিকা হউক! তুমি অমর হও! তুমি স্বাধীন হও! তোমার জয় হউক!

১৪২৮: তোমায় নিয়ে আশাবাদ

সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির স্বপ্নগুলো বাস্তব হোক নতুন বছরে। অন্ধকার ফিকে হোক ক্রমশ, অনাবিল আলোয় ভরে উঠুক বংলাদেশ। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, নেতির জয় কখনও হয়নি। বাঙালি জাতি খাদের কিনার থেকেও বার বার ফিরে এসেছে। তাই চোখে স্বপ্নটা থাক বর্তমান। অন্ধকার কাটিয়ে আলো আনার দায়িত্বটা সকলকেই নিতে হবে। সকলকে নতুন বছরের হার্দিক শুভেচ্ছা। নতুন বছর প্রত্যেকের ভাল কাটুক।

ভাল থাকাটা, ভাল হওয়াটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটা কালো অন্ধকার মেঘ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন একটা বছর সঙ্গে নিয়ে হাজির হবে বৈশাখের সকালে, ১৪২৮ পুরো সময়টা সেই সকালের মতোই ঝকঝকে হয়ে থাকুক,  উজ্জ্বল হয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাক, বৈশাখে থাক এই আশাবাদ।

গত বছরের আবর্জনা দূর হওয়ার প্রত্যাশায়, সর্ব অঙ্গে মলীনতা মেখে আমরা নতুন বছরকে আবাহন করেছি। অতীত ভয় দেখায়। আতঙ্ক তৈরি করে। অন্ধকার বাড়িয়ে দেয়। করোনার থাবায় ১৪২৭ এর পয়লা বৈশাখ জুড়ে ছিল না উৎসব। বারো মাসে তালিকায় বাংলা বছরের প্রথম দিনটা নিজস্ব মহিমায় স্থান করে নিতে না পারলেও হৃদয়ের বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ। আবার বৈশাখ, দেশ জুড়ে নতুন জামা, দোকানে দোকানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ, উষ্ণ আন্তরিকতা ফিওে আসুক নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন যার স্বাদ বছর ভরে চলবে।

দিন বদলের পালায় বাংলা বছর তার গরিমা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। বাংলা বছর এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দিন মাত্র। নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। এ সব আক্ষেপ এত দিনে বাঙালির গা-সওয়া। কিন্তু হিসেবের নতুন বছরের খাতা খোলার লগ্নে হাতে কী রইল, তা ভুললে চলে না।

একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, কিছু দিন ধরে চার দিকে যে সব কা- ঘটে চলেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ছন্দ যে ভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং খাচ্ছে, যেভাবে ভাবনায় দীর্ঘ ছায়া ফেলছে ভয় এবং অবিশ্বাস, তাতে বাঙালি জাতির গৌরবের ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়টার প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সর্বত্র। বৈশাখেই নিজেদের ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের ঢাক পেটানোর দিনে আত্মসমীক্ষা এবং নিজের বিচার জরুরি।

পরিবর্তন এল, তার সঙ্গী আছে কিছু স্বপ্নও। লোক বিশ্বাস, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু এগারো বছর পেরিয়ে আবার চার পাশে কেমন এক অস্থিরতার বাতাবরণ। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তবে কেন?

সব কিছুতেই রাজনীতি এবং চক্রান্ত দেখতে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বেশ পটু হয়ে উঠছে। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করলেই তাতে কেউ কেউ দ্রুত চক্রান্তের গন্ধ টের পেয়ে যান। যারা শাসকের আসনে থাকেন, গন্ধবিচারের ক্ষমতাও আবার তাঁদেরই বেশি থাকে! নিজেদের কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের জন্য ভুল স্বীকার নেই। দল-মত-রং নির্বিশেষে এটা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ। সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

অসহিষ্ণুতা? কেন এত হিংসা? বাতাসে কেন এত বিষ? আমরা কি পরস্পরের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছি? যাঁরা রাজনৈতিক কান্ডারি, আস্থা ও বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি করার বড় দায়িত্ব কিন্তু তাঁদেরই থাকে। কারণ তাঁরা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে দায়বদ্ধ। সেখানে শিথিলতা ঘটলে বিষয়টি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পর্যবসিত হয়। শরীর শক্তপোক্ত না হলে যেমন রোগ সহজে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়, ব্যাপারটি তেমনই চলমান।

এগারো বছরে অনেকটাই বদলেছে বাংলাদেশের চেহারা। শহর থেকে গ্রাম, সেই বদলের মুখচ্ছবি স্পষ্ট। একের পর এক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষ সরাসরি লাভবান। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আত্মিক ‘উন্নয়ন’ হয়তো প্রকৃত অর্থেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তবু কেন মানুষের এত অবিশ্বাস বাড়ছে রাজনীতিকদের ওপর? শিক্ষিত সমাজের একটু সদিচ্ছা, সততা, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রতিস্পর্ধাহীন মানসিকতা দরকার। ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠার উদারতা। মানুষের গণতন্ত্রে শিক্ষিত সমাজ বড় গুরুত্বপূর্ণ। এতটুকু উদারতা বাঙালি শিক্ষিত সমাজ দেখাতে বদ্ধপরিকর হতে পারলে বাঙালির নববর্ষ সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে উঠবে। যার গর্বিত ভাগীদার হবে সমগ্র জাতি।

গোটা বছর ধরে অনেক রকম সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবাত্মার সাংঘাতিক অসম্মান ঘটিয়ে বাংলার নানা প্রান্তে মাথা তুলেছে হিংসার বিষ। অশান্ত, উত্তপ্ত, রক্তাক্ত হয়ে রইল বাংলার মাটি। গণতন্ত্র নিয়ে রাজনীতিকদের নির্লজ্জ ও বেনজির আঘাত এবং মিথ্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। আরও নানা নেতি হানা দিয়েছে এবং হানা দিতে চাচ্ছে নানা রন্ধ্র পথে।

ইতিবাচক কিছু ঘটেনি গত একটা বছরে, এ কথা বলা যায় না যদিও প্রাণঘাতী করোনার হানায় নাকাল পুরো বিশ্ব। জীবন তার আপন ছন্দ, রূপ, রং, স্পর্শ, আঘ্রাণ নিয়ে নিরন্তর সামনের দিকে নিয়ে চলেছে আমাদের প্রত্যেককেই। শত-সহ¯্র নেতির সাক্ষী হতে হলেও সেই নিরন্তর অগ্রগতিতেই ইতিবাচকতার সবচেয়ে আনন্দ। বছরের শেষ সকালে পৌঁছে খেরো খাতার শেষ পাতায় অগ্রগতির যোগফল থাক, সে যোগফলকে নতুন খাতায় তুলে নেয়ার তোড়জোড় থাকুক দেশবাসীর মধ্যে। নেতির হিসেব ওই শেষ পাতাতেই শেষ হয়ে যাক। বয়ে যেন না নিতে হয় পরের নতুন খাতায়। অঙ্গীকারটা এমনই হোক।

দুটো ১৪২৭-১৪২৮ এর মধ্যে অনেকখানি ব্যবধান সঞ্চারিত হোক পৃথিবীর একটা মাত্র আবর্তনকে সাক্ষী রেখে, ১৪২৮-এর শুরুতে অনেক কিছু নতুন আলোয় ধরা দিক, এমনই আকুতি সময়ের চোখে। নতুন বছর বার বারই প্রতীকী তারুণ্য নিয়ে ধরা দেয়। কার্যক্ষেত্রে এ যুগে ইংরেজি নতুন বছরটাই আসল নতুন বছরের তকমা আদায় করে নিয়েছে। বাংলা নববর্ষ কার্যত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। তবু পয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালি মননে স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ, নির্মল অস্তিত্ব নিয়ে ধরা দেয় আজও। অতএব, পয়লা বৈশাখ আজও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ধিক্ষণ, যে সন্ধিক্ষণে জীবনের শপথগুলোকে ঝালিয়ে নেয়া যায় নিষ্কলুষ। অনেক কিছু হয়তো ভুল হয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু হয়তো অনাকাক্সিক্ষত পথে এগিয়েছে, গোলমাল হয়ে গিয়েছে হয়তো অনেক রকম হিসেব গোটা একটা বছর ধরে। সেই সমস্ত ভেস্তে যাওয়া হিসেবের খাতা সপাটে বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে ফেলার অবকাশ এবারেও নিয়ে এসেছে পয়লা বৈশাখ।

শান্তির জন্য ‘সূফী ইসলাম’ ডাক দিয়ে যায়

শাহ্ ফুয়াদ ॥ অসংখ্য সূফী সাধক-অলি-আউলিয়া-দরবেশের পূণ্য কর্মে এদেশে শান্তির বার্তা হিসেবে এসেছিল ইসলাম ধর্ম। কিন্তু ইসলাম নিয়ে এ বাংলায় রাজনীতি নতুন নয়। ১৯৭১ সালের এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মানুষ দেখেছিল ধর্মের নামে কী জঘন্য কাজ করেছিল এদেশেই জন্ম নেয়া পাপীষ্ঠ কিছু কিছু মানুষ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেদিন ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা, নারী নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল ধর্মব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার অবকাশ এ লেখায় নেই। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর ক্ষমতায় জুড়ে বসা পাকিস্তানী শাসকচক্র তাদের রাজনৈতিক তথা কায়েমী স্বার্থে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহারের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বসে এবং এর অপব্যবহার করতে থাকে। সদ্য জন্মলাভকারী পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমী স্বার্থে ব্যবহারের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠে এই পবিত্র ইসলাম ধর্ম । এই ধর্মব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা পাকিস্তানী শাসকচক্র ছিলো একে অপরের পরিপূরক।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও দেশবাসী যখন আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে তখন পাকিস্তানী শাসনামলের সেই দিনগুলো কীভাবে মূল্যায়ন বা উপলব্ধি করবে বা করতে পারছে নতুন প্রজন্ম তা হয়তো গবেষণার বিষয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সেই ঘৃণ্য ধর্মব্যবসায়ীরা এখনো সমাজের সব স্তরের মানুষকে মিথ্যার বেড়াজালে আটকে রেখে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধার করে আরাম-আয়েশ করে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি ঢাকার বাইতুল মোকাররাম মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও সরাইলে এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে যেভাবে রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে তা ধর্মব্যবসায়ীদের ১৯৭১’এর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডেরই নতুন রূপ। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বিলাসবহুল রিসোর্টে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তথাকথিত হেফাজত নেতাকে জনতার হাতে হাতেনাতে আটককে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃস্টি হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হেফাজত নেতার প্রতি একশ্রেণীর মানুষের অন্ধভক্তির কারণে তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, তাদের নেতা এমন কাজ করতে পারে। ধর্মভীরুতা থেকে ধর্মান্ধতার রূপ কেমন হতে পারে, মিথ্যাচারে এরা কতটুকু পারঙ্গমতা, দক্ষতা অর্জন করেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও মানুষের প্রতিক্রিয়া এর একটি উদাহরণ মাত্র।

 অথচ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেরও বহু  আগে এদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে যার যার ধর্ম পালন করে এসেছে যা ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এবং তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এই বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের প্রায় দুই শ’ বছর (১৩৩৮-১৫৩২) মুসলিম সুলতানগণ ক্ষমতায় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা সব ধর্মের মানুষের প্রতি ছিলেন সহনশীল। এক্ষেত্রে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪২), আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ (১৪৯২-১৫১৯), নূসরত শাহ্, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের (১৫১৯-১৫৩২) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের সময়ে বাংলার মান-মর্যাদা- গৌরব উচ্চ শিখরে উঠেছিল যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই সুলতানগণ সুফী-দরবেশ-আউলিয়াদেরকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন এবং তাঁরা বিভিন্ন স্থানে সূফীদের জন্য দরবার শরীফ-খানকা শরীফ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন, পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময় শ্রীচৈতন্য বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সূফী-দরবেশদের প্রতি সুলতানের সম্মানবোধ ও আচরণ শ্রীচৈতন্যকে তাঁর ধর্ম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেছিলো বলে বাউল ধর্মমতাবলম্বী অনেকে মত ব্যক্ত করে থাকেন। ন্যায়বিচারক সুলতান হিসেবে সমধিক খ্যাতির অধিকারী গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে আজও বর্তমান। মূলত বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তভিত্তিটা সুলতানী আমলেই তৈরি হয়েছিল।   

বাংলায় সূফী-দরবেশদের প্রচারিত ধর্মের মূলে ছিল মানবতাবাদ। ফলে অন্যান্য ধর্ম বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের জাতি-ভেদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে নি¤œ বর্ণের নিষ্পেষিত মানুষেরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় স্থান করে নিয়েছিল। তবে সূফীদের ইসলামের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজ শাসন। কারণ, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল এদেশের ফকীর-দরবেশ-সন্নাসীরাই। এঁদেরই প্রধান ফকির ফজনু শাহ নামটি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও পরে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার কোলকাতা ও ঢাকায় আলিয়া মাদ্রাসার মতো অসংখ্য মাদ্রাসা ভারবর্ষে  প্রতিষ্ঠা করে তাদেরই মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করে এবং অসংখ্য মৌলভী তৈরি করে সর্বত্র প্রেরণ করে। ইসলাম ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ (ফতোয়া) তখন থেকেই ইংরেজ শাসকদের অনুকূলে যেতে শুরু করে। ফলে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো মোল্লা-মৌলভী কথা বলেছেন এমন ঘটনা পাওয়া যায় না। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃস্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটো রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রেও একই দৃশ্যপট-বরং আরও শক্তিশালী হয়ে এই ধর্মব্যবসায়ীরা বিশেষ করে পূর্ববাংলার জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদর-আলশাম্স এবং পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংসতাই এর প্রমাণ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ণ, নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে দিতে পাকিস্তানীরা ইসলাম ধর্ম এবং এর নবীজীকে কীভাবে ব্যবহার করতো তার তার একটি উদাহরণ তুলে ধরে হলো। মহাকালের অগ্নিপুরুষ সূধী সাধক মওলানা ভাসানী তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক (জেনারেল সেক্রেটারি)। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেদিন ‘প্রতিরোধ দিবসে’র ডাক দিলো সেদিনটিতে সরকারের মদদপুস্ট হয়ে একটি গ্রুপ ভারতের কাশ্মীরে নবীজির অবমাননা হয়েছে বলে অন্য কর্মসূচি নিয়ে আসলো। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বিবৃতিতে (দৈনিক আজাদে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত) ঘটনাটি ‘ প্রতিরোধ দিবস প্রসঙ্গ জনাব মুজিবর রহমান কর্ত্তৃক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ’ শিরোনামের খবরে ঘটনাটি ফুটে উঠেছে এভাবে-“করাচী, ১লা ফেব্রুয়ারী।- পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান এম, সি, এ অদ্য নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়াছেন: ‘গত ২৯শে জানুয়ারী “প্রতিরোধ দিবস” পালন সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে যে বিবরণী প্রকাশিত হইয়াছে তাহা পাঠ করিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। এই সকল সংবাদে ২৯শে জানুয়ারী তারিখের “প্রতিরোধ দিবস” পালন সম্পর্কে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হইয়াছে। প্রায় ১৫ দিন পূর্ব্বে মওলানা ভাসানী এই দিবস পালনের কথা ঘোষণা করেন এবং এই সম্পর্কে প্রস্তুতিমূলক কার্য্য যখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছে, তখন কিছু সংখ্যক লোক ভারতে এক শ্রেণীর সংবাদপত্র কর্ত্তৃক হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে অবমাননাকর ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের তারিখ হিসাবে উক্ত দিনটিকেই বাছিয়া লন। হজরত মোহাম্মদের প্রতি এইরূপ জঘন্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন সম্পর্কিত এইরূপ একটি সভার প্রতি আমাদের অবশ্য পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তারিখ ও সময় নির্দ্ধারণের ব্যাপার দেখিয়াই আমাদের মনে গভীর সন্দেহ জাগে। কারণ, কিছু সংখ্যক লোক যে জনসাধারণের মনোভাবের সুযোগ লইয়া আমাদের উদ্দেশ্য পন্ড করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়া থাকে, এইরূপ অভিজ্ঞতা অতীতেও আমরা লাভ করিয়াছি।- এ, পি, পি।

উল্লেখ্য, ইতিহাসে দেখা যায়, পাকিস্তানী শাসন-শোষণে এবং তৎকালীন পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল এবং এই অবস্থানের অবসানে প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এই ‘প্রতিরোধ দিবস’এর ডাক দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘এই কিছুসংখ্যক লোক’ই যে ধর্মব্যবসায়ী এবং সরকারের লোক সেটি বুঝতে সচেতন কোনো মানুষেরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অত্যন্ত প্রতাপশালী পাকিস্তানী শাসকচক্র ও ধর্মজীবী-ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের ভাষাটুক ব্যক্ত করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই ধর্মব্যবসায়ীরা এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরা পেরে উঠে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। এদের মুখোশও উন্মোচিত হয়েছিল। যদিও এদের কেউ এখন আর রাজাকার পরিচয় দিতে চায় না। 

কিন্তু ‘চোরে না-শুনে ধর্মের কাহিনী।’ তাই তারা ধর্মের নামে অধর্মের কাজ করতে কখনও থেমে থাকেনি।  আজও ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন লেবাস পরে ‘এই কিছু সংখ্যক লোক’ বাংলাদেশের মানুষের শান্তি বিনষ্ট করতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল অর্জন ধূলিসাৎ করে দিতে দেশি-বিদেশি অপশক্তির ইন্ধনে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধার নানা ফাঁক-ফোকরে ‘ এই কিছু সংখ্যক লোক’ আরও হৃষ্টপোষ্ট হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ২১ বার হত্যার প্রচেস্টা চালিয়েছে। এদের আরও যতসংখ্যক  ষড়যন্ত্র যা সচেতন দেশবাসী কারোরই অজানা নয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে পাকিস্তানী ও সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট ধর্মব্যবসায়ীরা কতটুকু কদাচার  দেখাতে পারে তার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ এবার দেখা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এদের এক নেতার মুখোশ উন্মোচন হলো সোনারগাঁওয়ের হোটেলে। এদের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৩ জন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটলো। নিহত এসব পরিবারের লোকদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি থাকলে কেউ এইসব হোটেলে এভাবে যেতে পারে না। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে তাদেরই পৃষ্ঠপোষতায় তৈরি কোনো মাদ্রাসায় সূফীতত্ত্বের তথা মানবতাদের চর্চা হবে, দেশ ও মানুষের পক্ষে কথা বলবে, ধর্মের শান্তি ও সত্যের বাণী তুলে ধরবে সমাজ ও দেশের কলাণে এমনটি আশা করা পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিগত ২০/২৫ বছর ধরে সারা দেশের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও শত শত মাদ্রাসা সৃস্টির পেছনে কী উদ্দেশ্য, এসবে কী ধর্মের কী পড়ানো হয়, এসব থেকে পাশ করা ছাত্র’ছাত্রীরা দেশ-জাতি-ধর্ম এমনকি নিজের কল্যাণে কী ভূমিকা ও পালন করছে -এসব বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের কোনোই বক্তব্য নেই। তবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাধারণ মানুষ তথা মানবতার কল্যাণে এসব মাদ্রাসা কী কাজ করছে তা সচেতন ও বিবেকবান মানুষেরা ঠিকই বুঝতে পারছেন। ভোগবাদী এইসব খারেজী ধর্মব্যবসায়ীকে ধর্মের কাজ থেকে যতদূরে রাখা যাবে ততই মঙ্গল বলে অভিমত দিচ্ছেন বিবেকবান মহল।  উল্লেখ্য, সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে ইসলামের মর্মবাণী প্রথম প্রচারিত হয়েছিল আজ থেকে ৭ শ’ বছর আগে। খড়মপুরে সূফী সাধক সৈয়দ আহমদ গেছু দরাজ বা শাহ্ পীর (কল্লা শহীদ), শাহজাদাপুরে সূফী সাধক শাহ্ রুকুনউদ্দিন আনসারীএঁর পবিত্র দরগাহ এই ইতিহাসের উজ্জলতম নিদর্শন। শাহজাদাপুর গ্রামে বড় বড় কয়েকটি দীঘি আজও প্রমাণ করে সূফী সাধকগণ জনহিতকর কাজে কীভাবে নিজের নিজের জীবনকে ব্যয় করেছিলেন। আর আজ থেকে ৫ শ’ বছর আগে দিল্লির মোগল শাসন থেকে বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ঈশা খাঁর পিতা কালীদাস গজদানী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তরফ-বিজেতা আউলিয় সৈয়দ নাসিরউদ্দিনের প্রপৌত্র সৈয়দ ইব্রাহীমএঁর কাছে। সৈয়দ ইব্রাহীম খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিলেন। বিদ্যার্জন করে তিনি বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্ (১৪১৫-১৪৩১) থেকে মালেকউল উলামা উপাধিপ্রাপ্ত হন। (হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, পৃ.৩০)। অর্থাৎ, এ অঞ্চলে সূফী ইসলামের প্রবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং তাঁরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। তাঁদের দরগাহ আজও সব ধর্মের, সর্বস্তরের মানুষের, শান্তি ও মঙ্গলের প্রত্যাশীদের মিলনকেন্দ্র। তখন এই অঞ্চলে কোনো মাদ্রাসা-মসজিদ ছিল না। অথচ আজ এত মাদ্রাসা-মসজিদ থাকা সত্ত্বেও নিজের দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের জনকের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সময়ে এত অশান্তি-হানাহানির কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে-দেশকে এগিয়ে নিতে হলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সূফী সাধকদের প্রচারিত ইসলামের মর্মবাণী প্রচারে আজকের দিনের মাদ্রাসা-মসজিদ-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে সরকার ও প্রশাসন এবং সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে-এটিই আজ দেখতে চায় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা।

সময়ের সাফ কথা…. নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা

অনেক বাঙালিই সাম্প্রদায়িক রোগে আক্রান্ত নিরাময় ঘটাতে হবে মানসিক স্থবিরতার

সংলাপ ॥ গলদ রোগ রয়ে যাচ্ছে চেতন জগতের শেকড়েই। সমস্যাটা শেকড়ে বলেই রোগমুক্তিটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওপরে ওপরে চিকিৎসা করে লাভ খুব হবে না, গভীরে গিয়ে নিরাময় ঘটাতে হবে এই মানসিক স্থবিরতার। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি কোনও জাতির বা ভাষার বা ধর্মের বা বর্ণের ঐকান্তিক অধিকার বা পরিচিতি নয়। এই সবই আসলে চলমান সভ্যতার শিক্ষা, প্রতিটি সভ্য মানুষের পরিচিতি, প্রতিটি সভ্য মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট। কিন্তু সে কথা আমরা স্মরণে রাখছি না। সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং সভ্যতার দোহাই পেড়ে উন্মত্তদের থামতে বলছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বার বার বলছেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, অথবা ‘বাংলাদেশে এ সব হয় না’ অথবা ‘বাঙালির সংস্কৃতিতে এ সব নেই’। আমাদের প্রত্যেককে স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর সব সভ্য মাটিই দুর্জয় ঘাঁটি, পৃথিবীর কোনও সভ্য প্রান্তেই এ সব হয় না, পৃথিবীর কোনও সভ্য সংস্কৃতিতেই এ সব নেই। শুধু বাংলাদেশ  খুব উদার, সহিষ্ণু এবং মানবিক আর উপ-মহাদেশের অন্য নানা প্রান্ত অনুদার, অসহিষ্ণু এবং অমানবিক এই ধরনের মন্তব্য বা মতামত বা ভাব প্রকাশের মধ্যেও একটা সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। সেটাকে আমরা চিনতে পারি না অনেকেই। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই এই সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। যে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে আজ। অতএব প্রত্যেককে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। কণামাত্র সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বও থাকলে, তারও বিনাশ ঘটাতে হবে। তা হলেই মৌলিক পরিবর্তনটা আসবে। তা হলেই এই অনর্থক এবং বর্বরোচিত অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারব আমরা। বাংলাদেশে এ সব হয় না, বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় না এ জাতীয় সারবত্তাহীন মন্তব্য করে লাভ নেই। কারণ তাতে সঙ্কটমুক্তির কোনও পথ নেই। আমরা যে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি, সেই বার্তাটা চারিয়ে দেয়াই সবচেয়ে জরুরি। একটা বিভাজন যখন রক্তাক্ত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে, তখন বাঙালি আর বাংলাদেশী বা বাঙালি মুসলমান আর মুসলমান বাঙালি বা বাংলা আর না-বাংলার মধ্যে বিভাজনের তত্ত্ব সামনে আনা যে বিচক্ষণতার কাজ নয়, সে কথা বোঝা জরুরি খুবই বিশেষ করে রাজনীতিক সম্প্রদায়ের।

দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, দেশের কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। মসজিদ মন্দির গীর্জা মঠ দরবার আস্তানা আশ্রম যাত্রী সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান।

তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা সমাজের  মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।

সাম্প্রদায়িকতার বা সঙ্কীর্ণতার প্রতিটি বীজকে চিহ্নিত করতে হবে, ছুঁড়ে ফেলতে হবে অস্তিত্বের অনেক দূরে। তার জন্য শুধু কোন এলাকায় নয়, গোটা দেশে শান্তি বহাল রাখার তাগিদ অনুভব করতে হবে। শুধু দেশকে নিয়ে নয়, গোটা পৃথিবীকে নিয়ে ভাবতে হবে। যে দিন সে ভাবে ভাবতে পারবে সবাই, সে দিন আর হয়তো দেখতে হবে না কোনরকম হিংসার পুনরাবৃত্তি।

সমাজ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত যে-ভাবে ব্যক্তিকে নাড়া দেয়, তার চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়, সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়তে পারে কর্মে। ব্যক্তি অনাগত দিনকে কল্পনায় যে-ভাবে আঁকছেন, সেই ছবি বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু একটা বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তি যে কর্মের জন্ম দিচ্ছেন, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে ওই ব্যক্তির তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য থাকে। ব্যক্তির যে কোন শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শিল্প সত্যনিষ্ঠ  তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ। ব্যক্তির নীতি আর ব্যক্তির কর্মের নীতি আলাদা হয়ে গেলে সত্যনিষ্ঠার প্রশ্নে বিচ্যুতি আসবেই, আর কোথাও না কোথাও সে ফাঁকি ধরাও পড়বে। সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভণ্ডামির দিকে আঙুল তুলতে পারলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া যায়। ব্যক্তির শিল্পগুণকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তার প্রেরণা-জাগানো কর্মে যে সুস্পষ্ট নৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, ব্যক্তির নৈতিক চেতনা আর তার কর্ম নীতির একাত্মতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানে কতটা পরিবর্তন এসেছিল বা আসছে, তা কতটা অভিপ্রেত ছিল বা আছে, এগুলো নিয়ে নিজের সাথে নিজের বা আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে জীবন ও কর্ম সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেই চলে।

চেতনায় বিপ্লব -আমরা বাঙালি

সংলাপ ॥ বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি।’

* একজন খাঁটি বাঙালি কখনো মিথ্যা বলে না।

* একজন খাঁটি বাঙালি একজন কুরআনিক মুসলিম।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদের পড়–য়ারা অনেকেই টাকা-পয়সার মোহে সমাজের সর্বস্তরে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিপনার কাজে লিপ্ত রয়েছে – এইসব বিভ্রান্তদের তালিকা তৈরি ও ভালমানুষ করার জন্য সমাজের সবাই এগিয়ে আসি।

* বর্তমানে শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী আর সংস্কৃতির নামে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে। তাই প্রতিটি বাঙালির জীবনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ, লালন ও পালন করি।

* সকল শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্ম গ্রামে। দেশকে সমৃদ্ধ করতে জন্মস্থান গ্রামের সাথে শহর-নগরের ব্যবধান  কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

* ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতদের করা ‘পলিটিক্স’ এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনীতি’ শব্দটির পরিবর্তে দিন বদলের পালায়  ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করি। জননীতি-অর্থাৎ শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগী, সৎ ও মুক্তচিন্তার যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে কাজের সুযোগ করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।

* ‘সত্য বলি, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, নিজে বাঁচি-দেশ ও জাতিকে বাঁচাই।’

* ধৈর্যশীল হয়ে, অন্যের দোষ ক্ষমা করে আল্লাহ্র দরবারে ক্ষমা পাওয়ার প্রার্থী হই।

* কর্ম ও চিন্তায় সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের পরিচয় দিই।

* প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করি এবং আত্মিক উন্নতি করি।

* ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন। তাই কর্ম করি সৃষ্টির সেবাতেই।

* সেই ফুল হই – যে ফুল প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু ঝরে যায় না।

সত্য প্রতিষ্ঠার সময় বহমান

বাঙালির ব্যাকুলতা : স্বাধীনতা দিবস ৭ মার্চ

বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এবং চরম সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংসদকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার সংকীর্ণমুক্ত হয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিক এটাই বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায়। অতীতের দলীয়  অদূরদর্শিতায় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই করতে হয়। তবেই জাতি কৃতজ্ঞ থাকে সেই রাজনৈতিক  দলের প্রতি।

* ৭ মার্চ বাংলার মানুষের শপথের দিন।

* ৭ মার্চ থেকে বাংলার মানুষ জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো।

* ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি বাক্য বাংলার মানুষের কাছে ছিল সত্য, বাস্তব ও প্রেরণামুখী।

* বাংলা আর বাংলার মানুষ যতদিন থাকবে ৭ মার্চ থাকবে।

* ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীন করার জন্য অনুপ্রেরণা, জাতির অধ্যাত্মশক্তি এবং বিশ্ব স্বীকৃত।

সংলাপ ॥ বাংলা-বাঙালি, বাংলাদেশ-এর জাতীয় জীবনে ৭ মার্চ ধ্রুব সত্য। সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, ১৫ কোটি মানুষের সাক্ষী গ্রহণ করা হলে, ৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস অবশ্যই পালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিলো যুদ্ধের ঘোষণা, মুক্তির ঘোষণা, যুদ্ধের কলা-কৌশলের ঘোষণা সর্বোপরি সরকার পরিচালনার ঘোষণা। পরবর্তীকালে যা কিছু ঘটেছে তা ৭ মার্চের ফসল। তাই  ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন ছিল জাতীয় চেতনার প্রকাশিত সত্য। ৭ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল তৎকালীন  রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অদূরদর্শিতার ফলে সত্য-মিথ্যার দোলায় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করে জাতিকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে ফেলেছে। তার ফল লাভ করছে ষড়যন্ত্রকারীরা। ৫ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ এই মাটিতেই দেখেছে – মুসতাক গং, জিয়া গং এবং যুদ্ধাপরাধীদের কার্যকলাপ ও মিথ্যাচারের সুযোগে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে সন্ত্রাস – যা আজো চলছে।

তাই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংসদে পাস করিয়ে ৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করুক বর্তমান সরকার, এটাই এখন জাতির প্রাণের দাবী। ওই সময়ের বিশ্বের কোটি কোটি সাক্ষী আর ১৫ কোটি বাঙালিকে জাতীয় জীবনে সত্যের পূজারী হতে বর্তমান সংসদ ও সরকার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিনটি স্বাধীনতা দিবস করার জন্য দিক্ নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত দিক এবং সংসদে পাস হোক-এটাই হবে বাঙালি জাতির সত্য প্রতিষ্ঠার নিদর্শন।

এটা সত্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাধা আসবে। সংবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন এতদিন পরে হলেও হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা এ বিষয়ে এগিয়ে আসলে সেটা হবে জাতির জন্য সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দিন বদলের পালায় ডিজিটাল বাংলার মানুষকে বাঙালি হয়ে বাঁচতে হলে, বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসাবে জাতীয় শ্রদ্ধার আসনে চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় বসাতে হলে এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় বাঙালি আপোষহীন এই প্রত্যয়ে মানবজাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি পেতে হলে এই সংসদ থেকে পরিবর্তনের বিল এনে আপনার সরকার ও সংসদ থেকে ঘোষণা আসুক ‘৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস’-এটাই জাতির প্রত্যাশা। সত্য-মিথ্যার দোলাচাল সব ভেঙ্গে সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক বাঙালির মনে-প্রাণে। গর্তের মধ্যে ঢুকে যাক ষড়যন্ত্রকারীরা ও বিষাক্ত সাপের বাচ্চাগুলো এবং বন্ধ করুন গর্তগুলো – শান্তির সুবাতাস গ্রহণ করুক বাঙালি জাতি উন্নয়নের পথে।

নতুন আলোয় উদ্ভাসিত মার্চ ২০২১!

শেখ উল্লাস ॥ মার্চ ১৯৭১ থেকে মার্চ ২০২১। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। ৫০ বছর আগের মার্চ মাস আর আজকের মার্চ মাসের প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই এক নয়। এক হওয়ার কোনো কারণও নেই। পরিবর্তন, বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়েই তো সময় এগিয়ে যায়। এই বাস্তবতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যারা চলতে পারে না তারাই হারিয়ে যায়। তবে মিথ্যাচার, মুনাফেকির আশ্রয় নিয়ে যারা টিকে থাকে, সমাজ ও মানুষের কল্যাণে এমন কি নিজেদের কল্যাণেও কিছুই করতে পারে না। সমাজে শুধু অশান্তি, বৈষম্য, অনাচার ও মিথ্যাচারের ধুম্রজালই তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ আবার শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিকও বনে যেতে পারে। কিন্তু টিকিয়ে রাখতে পারে না। ১৯৭১-এ বাংলার মানুষের বাস্তবতা ও চাওয়া-আকাঙ্খা যারা বুঝতে চায়নি, যারা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধ করেছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজাকার হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছিল, কোটি মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছিল তাদের কথাও ঘৃণাভরে স্মরণ করতে হয় এই মার্চে। ‘সত্য যে বড় কঠিন’!

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছরের পথ-পরিক্রমায় কত পিচ্ছিল পথই না পাড়ি দিতে হয়েছে লাখো শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা এই দেশটিকে। তবে সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে এসে বাংলাদেশ যে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত সে কথা অনস্বীকার্য। ২০২১’এর মার্চে প্রবেশের ঠিক তিন দিন আগে স্বল্পোন্নত  দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে পাঁচ দিন বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করে। সিডিপির এলডিসি-সংক্রান্ত উপ গ্রুপের প্রধান টেফেরি টেসফাসো এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। এর পরদিন গণভবন থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন ‘১২ বছর ধরে সরকার পরিচালনায় নিরন্তর পরিশ্রম এবং পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে এই অর্জন’। তিনি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার স্বীকৃতি তরুণ প্রজন্মকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেছেন, এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সরকার শুধু নীতি-সহায়তার মাধ্যমে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

উন্নয়নের চলমান গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে-এমন আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটল, যখন আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছি, আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।’ এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।’

আজ থেকে ৫০ বছর আগের মার্চ মাসের ধারাবাহিকতার ফসলই তো আজকের বাংলাদেশ। কেমন ছিল সেদিনের মার্চ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, ইতিহাসের সন্ধান করতে গেলে দেখা যায় যে, ১৯৭০’এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এক বেতার ভাষণে পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত  ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে স্বত:স্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ওইদিনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো’ ইত্যাদি শ্লোগানে ঢাকা আন্দোলিত ও বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। সারা বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) তখন উত্তাল। ঢাকার ফার্মগেটে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণও কারফিউ জারি করা হয়। পূর্বাণী হোটেলে সেদিন আওয়ামী লীগের এমএনএ-এমপিএদের বৈঠক চলছিল। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত করা খুবই দুঃখজনক। …আওয়ামী লীগের আপাত কর্মসূচি হচ্ছে, ১ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের আয়োজিত জনসভায় চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ ২ মার্চ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্রসভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকায় কারফিউ ভঙ্গ করে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বহু হতাহত হয়। ওই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী বলবেন সেই দিকে সবার দৃষ্টি। অবশেষে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যা হয়ে গেল বাঙালি জাতির অমর ইতিহাস। কবির ভাষায়, ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’।

সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ ৭ই মার্চ দিবসটিকে বাংলার ঘরে পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করে আসছে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এ দিবসটিকে সরকারি মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি এদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে সম্প্রতি। বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে আরও আগেই। ৭ই মার্চকে এখন অস্বীকার করতে পারছে না বিরোধী দল-বিএনপিও, যে দলের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে দলীয়ভাবে ৭ই মার্চ পালনের ঘোষণা দিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। দলের অন্যতম নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘৭ই মার্চ অবশ্যই ইতিহাস, পার্ট অব দ্য হিস্টরি। এদিন যে ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন তার সম্মান ও মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে।’

সব মিলিয়ে ২০২১ সালের মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে আবারও এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত। কারণ, ৭ই মার্চকে সবাই স্বীকার করে নিলে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যে দোলাচল, যে দ্বন্দ্ব ও অপরাজনীতি সমাজ-পরিবেশকে বিষিয়ে রেখেছে তা দূর হবে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজেও কোনোদিন বলেন নাই, বলার সাহসও তার ছিল না, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে দুপুর বেলায় চট্টগ্রামের কালুর ঘাটে স্বাধীনতাসংগ্রামী শব্দসৈনিকদের তৈরি করা বেতার কেন্দ্র (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন মাত্র। জিয়াউর রহমানকে ওই বেতার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও সশ্রস্ত্র যুদ্ধে যাওয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতাসংগ্রামীরাই। ঢাকায় ২৫ মার্চে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার পর এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যে যেখানে যেভাবে পেরেছে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ৭ মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা, ‘আমি যদি হুকুম দেয়ার নাও পারি..তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশনা মানতে ভুল করেনি বাঙালি জাতি। যে যেখানে পেরেছে সেভাবেই প্রতিরোধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটিই ছিল সকল যুদ্ধ ও শক্তির প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অনাহুত বিতর্কের অবসান হলে জাতির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথ-পরিক্রমা আরও মসৃণ হবে বলে অভিমত সচেতন মহলের।

তবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপনকে কেন্দ্র করে তৈরি আলোর মধ্যেই যে বিষয়টি অন্ধকার সৃষ্টি করে চলছে সেটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগে জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতির সর্বস্তরে তোষামদি, দালালিসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি সমাজকে কলুষিত করছে। দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত নিবেদিতপ্রাণ, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না যার প্রভাব পড়ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাসহ সকল কর্মকা-ে। সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে এ সমস্যাটি যতটুকু, তার চেয়েও বেশি প্রকট বিরোধী দল বিএনপিতে। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র তথা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনও শক্তিশালী ও বিকশিত হতে পারে না। চলমান পৌরসভা ও আসন্ন ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রস্তুতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু  এই মার্চ শুরুর আগের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের বাঁধা ও লাঠিপেঠার সম্মুখীন হয়ে বিএনপি ও ছাত্রদল ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তাতে সরকারি দলের একচ্ছত্রতা আরও শক্তিশালী হবে বলেই আশঙ্কা জানান দিয়েছে। এই একচ্ছত্রতা দেশের জন্য কতটুকু মঙ্গল ও অমঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে সেটাই এখন সচেতন মহলের চিন্তার বিষয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাগরিকদের কণ্ঠরোধ!!!

মারুফ রসুল।। আইন তৈরি ও তার প্রয়োগের ওপর রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ভর করে। বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করার যে দুঃশাসন নীতি সরকার গ্রহণ করেছে তা থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনিক চরিত্র বোঝা যায়। একটি নিপীড়নমূলক আইন কেবল তৈরি নয়, তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের বদ-উদ্দেশ্য বোঝা যায়। লেখক মোশতাক আহমেদ, কার্টুনশিল্পী আহমেদ কবির কিশোর বা এ যাবৎকালে এই নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারকৃতদের তালিকা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এটা করাই হয়েছে তথাকথিত ‘সরকারবিরোধী’ ও ‘তার তল্পিবাহকবিরোধী’ মন্তব্য দমনের জন্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের কোন আইনে আছে যে, সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না? সরকার ও তার প্রশাসনের লোকজন দুর্নীতি করবে, লুটপাট করবে, চুরি করবে, ক্ষমতার অপব্যবহার করবে আর জনগণ তার বিরোধিতা করবে না? সমালোচনা করবে না?

এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দমনমূলক ধারাগুলো নিয়ে বহুদিন ধরেই সচেতন নাগরিকরা প্রতিবাদ করে আসছেন। এই আইনের খড়গ সিংহভাগ সময়েই লেখক-প্রকাশক-বাউলশিল্পী-ব্লগারসহ সচেতন নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। বিনা বিচারে দিনের পর দিন কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। লেখক মোশতাক আহমেদকে তো হত্যাই করা হলো। হত্যা এ কারণেই যে, কারা-অভ্যন্তরে ঘটা প্রতিটি মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের। লেখক মোশতাক আহমেদ ও কার্টুনশিল্পী কিশোরের জন্য জামিন আবেদন করা হলেও আদালত তাদের জামিন দেয়নি। মেনে নিলাম জামিন দেয়া বা না-দেয়ার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত বিষয়ক আলোচনা আইনজীবীরাই ভালো বুঝবেন; কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন -অসুস্থ মোশতাক আহমেদের চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা কি কারা কর্তৃপক্ষ করেছিলো?

তারা যে সেটা করেনি, মোশতাক আহমেদের মৃত্যু এবং কিশোরের শারীরিক অবস্থাই তার প্রমাণ। অথচ এই রাষ্ট্র দিনের পর দিন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেছে। বহু শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিনা কারণেই হাসপাতালে ‘অবসর’ কাটায় এই খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখি। এই কিছুদিন আগেও হলমার্ক কেলেঙ্কারির আসামী কারাগারে আইনবহির্ভূত সুবিধা নিয়েছে কারা কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই। সিকদার গ্রুপের সন্ত্রাসীরা অপরাধ করে পালিয়ে যায়, আবার জামিন হবে জেনেই বিমানবন্দরে ধরা দেয়। হাজী সেলিমের ছেলেরও জামিন হয়। অপরাধ বিবেচনায় নয়, এসবই হয় ক্ষমতার জোরে, অর্থের জোরে। এ কারণেই মোশতাক আহমেদকে জেলখানাতেই মরতে হয়, কার্টুনশিল্পী কিশোরের জামিন হয় না, মাসের পর মাস বিনা বিচারে জেলে আটক থাকতে হয় বাউলশিল্পীদের, মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি খেলার মাঠের দাবি জানালে জেলে যেতে হয় চুয়াডাঙ্গার মানিক খানকে। কারণ তাঁদের ক্ষমতার জোরও নাই, অর্থের জোরও নাই- তাঁরা শিল্পী-লেখক-প্রকাশক-ব্লগার বা সাধারণ সচেতন নাগরিক। এদেশে ব্যাংক লুটেরা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা, মন্ত্রী-এমপি বা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ির সন্তানদের ক্ষেত্রে আইন খুব সরলরেখায় চলে। ধর্মব্যবসায়িদের ক্ষেত্রে আইন তো প্রায় চোখেই দেখে না। দেশে কয়টি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিচার হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব দেবার সময় রাষ্ট্রের লজ্জা লাগবে না?

দমনমূলক আইন প্রণয়ন ও উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে নাগরিকদের গলা টিপে, কণ্ঠরোধ করে কিংবা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তোষণ করে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো সরকার তার ক্ষমতাকে সুসংহত করতে পারেনি। যে গলাটেপা আইন আর প্রশাসনকে এখন ব্যবহার করছেন, তারাই একদিন আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে সেটা আপনারাও জানেন, আমরাও জানি।

সময়ের সাফ কথা….বঙ্গবন্ধুফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবিমাত্র

নজরুল ইশতিয়াক ॥ ছবির রাজ্যে, ছবির হাটে বিস্তর ক্রেতা বিক্রেতা। একটি ছবির পরিচয়, নির্বাক ছবির গায়ে লাগিয়ে সেলফি, পোষ্ট, লাইক, শেয়ার, কিছু মুখস্থ বয়ান, এই তো চলছে বঙ্গবন্ধুর নামে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে দেয়াল লিখনে, স্টিকারে, ব্যাজ-ক্যাপে, অফিসের দেয়ালে, ড্রয়িং রুমে, টি শার্টে বঙ্গবন্ধুর ছবি। পোট্রেট, ভাস্কর্যে, ব্যানারে, প্রোফাইল পিকে বঙ্গবন্ধু। বাঙালির জাতির হাজার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নানাভাবে বিভিন্ন জায়গায় থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো দেশপ্রেম, এটাই তো সচেতনতা, ভালোবাসা একটি প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ঘরে বাইরে সব জায়গায় বঙ্গবন্ধু থাকবে এটাই তো আমরা চাই।

বঙ্গবন্ধুকে ধারণ লালন পালনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নতি অগ্রগতি। তিনিই তো আমাদের দিশারী। কিন্তু ছবির মানুষটি যদি কেবলই ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হয়, বছরে কালে ভাদ্রে স্মরণ সভার বিষয়বস্তু হয়, দু’লাইন লেখনি, কিংবা কেবল আনুষ্ঠানিকতার গল্প হয়, তবে জাতি হিসাবে চরম লজ্জাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের এতে কোন সন্দেহ নেই। দেয়ালে সাটানো ছবি কেবলই নামকাওয়াস্তে একটি ছবি হয়ে থাকলে জাতি হিসাবে চরম অধঃপতিত অবস্থারই প্রকাশ পায়।

বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধু এ দেশের সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায়, প্রেমে, পূণ্যে আরাধ্য হয়ে উঠলেও লুটেরা, ক্ষমতাধরদের কাছে কেবলই একটি ফ্রেম, একটি ছবি মাত্র। মাথার উপরের দেয়ালে লাগানো জাতির জনক শেখ মুজিব ও দেশরত্ম শেখ হাসিনার ছবি, অথচ অনেকের  কর্মকান্ড এই দুই মহান দেশপ্রেমিকের আদর্শ, শিক্ষার ন্যূনতম প্রতিফলন নেই। বরং নির্বাক ছবির প্রতি চরম অবহেলা প্রকাশ পায়। এই তালিকায় সরকার দলীয় নেতা কর্মী বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিক্ষিত সজ্জন রয়েছেন।

এরা মুখে গলা ফাটিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রীতি দেখালেও কার্যত এরা মুনাফেক। এদের দ্বিচারিতা চরমে। বঙ্গবন্ধু এদের কাছে ন্যূনতম  প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেনি।

সরকারী অফিসে বঙ্গবন্ধু ও দেশরত্ম শেখ হাসিনার সাটানো ছবি মনে করিয়ে দেয় এটা বঙ্গবন্ধুর দেশ, এই দেশের স্বাধীনতা, সংগ্রাম, অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান। অথচ যে অফিসের দেয়ালে সাটানো ছবি সেখানেই পদে পদে ভূলুণ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর অবদান। বহু কর্মকতার কাছে জনগণ সেবা পায় না, অফিস কক্ষে বসেই ঘুষ, অনিয়ম চলে। চরম অশোভনীয় আচরণ করা হয় সেবা প্রত্যাশীদের।

এমন বহু কু-কীর্তির সংবাদ অতীতে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারিত হয়েছে। আর রূপকথার আলাদীনের চেরাগকে হার মানায় এদের দুর্নীতির ভয়াবহতায়। রাঘব বোয়ালরা ধরা না পড়লেও  সরকারী  গাড়ী চালক, পিয়ন টাইপের লোকের বিপুল সম্পদের খোঁজ মেলে। সংবাদমাধ্যমে তা উঠে আসে। তাহলে ক্ষমতাধরদের অবস্থা কেমন হতে পারে?? বহু বড় আমলা, ছোট আমলার নামে  লুটপাট দুর্নীতির অভিযোগ জানা যায়। আর আড়ালে থাকা খবর সংবাদপত্রে না এলেও জনগণ জানে। ফলে বুঝা যায় অফিস কক্ষের দেয়ালে সাটানো বঙ্গবন্ধুর ছবি কেবলই ছবি। কোন তাৎপর্য বহন করেনা।  শুধু তাই নয় এসব ক্ষমতাধর রথী মহারথীরা সমাজের নিচুতলার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। সরকারী পদবীকে নিজেদের আত্মীয় পরিজনের মালখানায় পরিনত করে।

অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সময়ে বারবার সতর্ক করে বলেছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের টাকায় এসব লোকের বেতন হয়। তিনি বলেছেন আমার সাধারণ মানুষ চোর না। সাধারণ মানুষের অবদানে অর্থনীতির চাকা সচল। সরকারী কর্মকতাদের বলেছেন আপনারা জনগণের সেবক, মালিক নন এটা মনে রাখবেন। সব কিছু ছাপিয়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো জুড়ে থাকতো নানান দুঃখজনক উপলব্ধির চিত্র। তিনি স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে চরিত্রহীন নষ্ট লোকদের চিনে ফেলে ছিলেন। এসব চরিত্রহীন একটা বড় অংশ সরকারী কর্মকতা ও দলীয় লোকজন। বাকশাল গঠনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করছি, সেটি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে আমার একটি মৃত্যু তো স্বাভাবিক ভাবে হবেই, আদর্শ হীনতার ফলে দ্বিতীয় মৃত্যু হবে। যেখান থেকে সহজে বের হওয়া যাবে না”।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবই উপলব্ধি করেছিলেন। ৭৪/৭৫ সালে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায়  আমলা, ব্যবসায়ী, দলীয়  নেতাকর্মীদের ভৎসনা করে বহু কথা বলেছেন। তিনি রাগ ঢাক না রেখেই সরাসরি এমন অনেক অপ্রিয় কথা বলেছেন যা এই মহান নেতার মনোকষ্ট ও উপলব্ধির গভীর সত্য তুলে ধরে।

এত বছর পরেও কানে ভেসে আসে জাতির জনকের কত শত আক্ষেপ হতাশার আওয়াজ। কতটা আক্ষেপে তিনি বলেছিলেন- ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। চাটার দল, চোর, বাটপার, প্রতারক, বিশ্বাস ঘাতক, মিথ্যাবাদী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ এসব বিশেষণগুলো কাদের উদ্দেশ্যে, কেন বারবার বলেছিলেন সেটা আমাদেরকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশরত্ম শেখ হাসিনা হয়তো বঙ্গবন্ধুর মতো খোলাখুলি বলছেন না। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি একই কথা বারবার বলেন।

জাতির জনকের কন্যা দৃশ্যত একই আক্ষেপ প্রকাশ করেন নানান অনুষ্ঠানে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদেশ নিষেধ উপদেশ আহবান পদে পদে উপেক্ষিত। লুটপাট, পাচারের পরিসংখ্যানটি যেমন ভয়াবহ, তেমনি সেবা গ্রহীতারাও উপেক্ষিত হচ্ছেন আজো। খোদ দলীয় নেতা কর্মীরাই অবলীলায় পায়ে মাড়ান। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।

এদেশ থেকে লুটপাট করে টাকা পাচারের অভিযোগের বেশির ভাগই সরকারী কর্মকতা। যাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর গল্প করতো সব সময়। বহু রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে এদের আওয়ামী প্রেমের। এছাড়া টাকা পাচারের সাথে জড়িত সরকার দলীয় সমর্থন পুষ্ট বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ীরাও বঙ্গবন্ধুকে কেবল একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মনে করে। স্পষ্টতই এরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গত বারো বছর যে বিপুল সংখ্যক লুটেরা টাকা পাচার করেছে তাদের বেশির ভাগ তো কোন না কোন ভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম পরিচয়ে পরিচিত লোক। অন্য দিকে ক্যাসিনো কান্ড, চাঁদাবাজি, চিকিৎসা জালিয়াতি সহ বহুমুখী কেলেঙ্কারির অভিযোগে গ্রেফতার প্রায় সবাই তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ফেরিওয়ালা। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় বিচারাধীন অধিকাংশই দেশরত্ম শেখ হাসিনা ও জাতির জনকের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। ব্যাংক লুটেরাদের একটা বড় অংশ প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করে বেড়ান। কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর গল্প বলেন। এদের বঙ্গবন্ধু প্রেম দেখলে বুঝার উপায় নেই এরা লুটেরা।

টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার ক্ষমতায় থাকায় সবাই এখন বঙ্গবন্ধু প্রেমি হয়ে উঠেছেন। যারা এক সময় বঙ্গবন্ধুর নামে যা খুশি তা বলতো, তারা এখন বঙ্গবন্ধু গবেষক, বহু বই ইতোমধ্যে লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্ম নিয়ে। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর এই সময়ে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে বঙ্গবন্ধু এখন কেবলই ছবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জীবিত থেকেও একটি ছবি হয়ে উঠেছেন। অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরা যায় এ ব্যাপারে। দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্ব গুণগত মান ক্ষয়ে গেছে, ধসে পড়েছে পুরোপুরি। কোন সৌন্দর্য সুকুমার বৃত্তি চোখে পড়ে না। মুখস্থ কিছু আওয়াজে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা নামটি উচ্চারিত হয় মাত্র। এরা শ্লোগান দেয় অথচ ধারণ করে না। বাঙালি জাতীয়তাবোধের কথা বলে অথচ বাংলার ইতিহাস জানে না। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব কপচায় অথচ উপলব্ধি করে না। বহু সংসদ সদস্য, মাননীয় মন্ত্রীর চলনে বলনে কর্মকান্ডে বুঝার উপায় নেই এরা একটি ঐতিহ্যের পরম্পরা সৌন্দর্য বহন করছে। কোথায় কোন  বিশেষত্ব ধরা পড়ে না। মনোনয়ন বাণিজ্য, ভাই ভাস্তে কমিটি তো ওপেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মারামারি সংঘাতের ভয়াবহতা প্রমান করে তলানীতে এসে ঠেকেছে দলীয় শৃঙ্খলা। আত্মীয়করণ, মামা খালু মহল। ফলে অবলীলায় পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছে সব আদর্শ। একদিকে বিস্ময়কর চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন অন্য দিকে ধসে পড়ছে বাঙালির জাতি বোধের স্তম্ভগুলো। আদর্শবিচ্যুতির ফল ভালো হয় না। সময় বহমান-দেশ ও জাতির স্বার্থে এসব চাটার দলকে চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার।