নজরুল ইশতিয়াক ॥ ছবির রাজ্যে,
ছবির হাটে বিস্তর ক্রেতা বিক্রেতা। একটি ছবির পরিচয়, নির্বাক ছবির গায়ে লাগিয়ে সেলফি,
পোষ্ট, লাইক, শেয়ার, কিছু মুখস্থ বয়ান, এই তো চলছে বঙ্গবন্ধুর নামে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে,
অলিতে গলিতে দেয়াল লিখনে, স্টিকারে, ব্যাজ-ক্যাপে, অফিসের দেয়ালে, ড্রয়িং রুমে, টি
শার্টে বঙ্গবন্ধুর ছবি। পোট্রেট, ভাস্কর্যে, ব্যানারে, প্রোফাইল পিকে বঙ্গবন্ধু। বাঙালির
জাতির হাজার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি
নানাভাবে বিভিন্ন জায়গায় থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো দেশপ্রেম, এটাই তো সচেতনতা,
ভালোবাসা একটি প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ঘরে বাইরে সব জায়গায় বঙ্গবন্ধু থাকবে এটাই
তো আমরা চাই।
বঙ্গবন্ধুকে ধারণ লালন
পালনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নতি অগ্রগতি। তিনিই তো আমাদের দিশারী।
কিন্তু ছবির মানুষটি যদি কেবলই ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হয়, বছরে কালে ভাদ্রে স্মরণ সভার
বিষয়বস্তু হয়, দু’লাইন লেখনি, কিংবা কেবল আনুষ্ঠানিকতার গল্প হয়, তবে জাতি হিসাবে চরম
লজ্জাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের এতে কোন সন্দেহ নেই। দেয়ালে সাটানো ছবি
কেবলই নামকাওয়াস্তে একটি ছবি হয়ে থাকলে জাতি হিসাবে চরম অধঃপতিত অবস্থারই প্রকাশ পায়।
বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধু
এ দেশের সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায়, প্রেমে, পূণ্যে আরাধ্য হয়ে উঠলেও লুটেরা,
ক্ষমতাধরদের কাছে কেবলই একটি ফ্রেম, একটি ছবি মাত্র। মাথার উপরের দেয়ালে লাগানো জাতির
জনক শেখ মুজিব ও দেশরত্ম শেখ হাসিনার ছবি, অথচ অনেকের কর্মকান্ড এই দুই মহান দেশপ্রেমিকের আদর্শ, শিক্ষার
ন্যূনতম প্রতিফলন নেই। বরং নির্বাক ছবির প্রতি চরম অবহেলা প্রকাশ পায়। এই তালিকায় সরকার
দলীয় নেতা কর্মী বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিক্ষিত সজ্জন রয়েছেন।
এরা মুখে গলা ফাটিয়ে বঙ্গবন্ধু
প্রীতি দেখালেও কার্যত এরা মুনাফেক। এদের দ্বিচারিতা চরমে। বঙ্গবন্ধু এদের কাছে ন্যূনতম প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেনি।
সরকারী অফিসে বঙ্গবন্ধু
ও দেশরত্ম শেখ হাসিনার সাটানো ছবি মনে করিয়ে দেয় এটা বঙ্গবন্ধুর দেশ, এই দেশের স্বাধীনতা,
সংগ্রাম, অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান। অথচ যে অফিসের দেয়ালে সাটানো ছবি সেখানেই পদে
পদে ভূলুণ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর অবদান। বহু কর্মকতার কাছে জনগণ সেবা পায় না, অফিস কক্ষে বসেই
ঘুষ, অনিয়ম চলে। চরম অশোভনীয় আচরণ করা হয় সেবা প্রত্যাশীদের।
এমন বহু কু-কীর্তির সংবাদ
অতীতে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারিত হয়েছে। আর রূপকথার আলাদীনের চেরাগকে
হার মানায় এদের দুর্নীতির ভয়াবহতায়। রাঘব বোয়ালরা ধরা না পড়লেও সরকারী
গাড়ী চালক, পিয়ন টাইপের লোকের বিপুল সম্পদের খোঁজ মেলে। সংবাদমাধ্যমে তা উঠে
আসে। তাহলে ক্ষমতাধরদের অবস্থা কেমন হতে পারে?? বহু বড় আমলা, ছোট আমলার নামে লুটপাট দুর্নীতির অভিযোগ জানা যায়। আর আড়ালে থাকা
খবর সংবাদপত্রে না এলেও জনগণ জানে। ফলে বুঝা যায় অফিস কক্ষের দেয়ালে সাটানো বঙ্গবন্ধুর
ছবি কেবলই ছবি। কোন তাৎপর্য বহন করেনা। শুধু
তাই নয় এসব ক্ষমতাধর রথী মহারথীরা সমাজের নিচুতলার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের
চোখে দেখে। সরকারী পদবীকে নিজেদের আত্মীয় পরিজনের মালখানায় পরিনত করে।
অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান বিভিন্ন সময়ে বারবার সতর্ক করে বলেছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের টাকায় এসব
লোকের বেতন হয়। তিনি বলেছেন আমার সাধারণ মানুষ চোর না। সাধারণ মানুষের অবদানে অর্থনীতির
চাকা সচল। সরকারী কর্মকতাদের বলেছেন আপনারা জনগণের সেবক, মালিক নন এটা মনে রাখবেন।
সব কিছু ছাপিয়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো জুড়ে থাকতো নানান দুঃখজনক উপলব্ধির
চিত্র। তিনি স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে চরিত্রহীন নষ্ট লোকদের চিনে ফেলে ছিলেন।
এসব চরিত্রহীন একটা বড় অংশ সরকারী কর্মকতা ও দলীয় লোকজন। বাকশাল গঠনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধু
বলেছিলেন “যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করছি, সেটি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে আমার একটি মৃত্যু
তো স্বাভাবিক ভাবে হবেই, আদর্শ হীনতার ফলে দ্বিতীয় মৃত্যু হবে। যেখান থেকে সহজে বের
হওয়া যাবে না”।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবই উপলব্ধি করেছিলেন। ৭৪/৭৫ সালে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় আমলা, ব্যবসায়ী, দলীয় নেতাকর্মীদের ভৎসনা করে বহু কথা বলেছেন। তিনি রাগ
ঢাক না রেখেই সরাসরি এমন অনেক অপ্রিয় কথা বলেছেন যা এই মহান নেতার মনোকষ্ট ও উপলব্ধির
গভীর সত্য তুলে ধরে।
এত বছর পরেও কানে ভেসে
আসে জাতির জনকের কত শত আক্ষেপ হতাশার আওয়াজ। কতটা আক্ষেপে তিনি বলেছিলেন- ‘সবাই পায়
সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। চাটার দল, চোর, বাটপার, প্রতারক, বিশ্বাস ঘাতক,
মিথ্যাবাদী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ এসব বিশেষণগুলো কাদের উদ্দেশ্যে, কেন বারবার বলেছিলেন
সেটা আমাদেরকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বাধীনতার ৫০ বছরে
এসে দেশরত্ম শেখ হাসিনা হয়তো বঙ্গবন্ধুর মতো খোলাখুলি বলছেন না। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
তিনি একই কথা বারবার বলেন।
জাতির জনকের কন্যা দৃশ্যত
একই আক্ষেপ প্রকাশ করেন নানান অনুষ্ঠানে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার
আদেশ নিষেধ উপদেশ আহবান পদে পদে উপেক্ষিত। লুটপাট, পাচারের পরিসংখ্যানটি যেমন ভয়াবহ,
তেমনি সেবা গ্রহীতারাও উপেক্ষিত হচ্ছেন আজো। খোদ দলীয় নেতা কর্মীরাই অবলীলায় পায়ে মাড়ান।
চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
এদেশ থেকে লুটপাট করে টাকা
পাচারের অভিযোগের বেশির ভাগই সরকারী কর্মকতা। যাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর গল্প করতো সব
সময়। বহু রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে এদের আওয়ামী প্রেমের। এছাড়া টাকা পাচারের সাথে জড়িত
সরকার দলীয় সমর্থন পুষ্ট বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ীরাও বঙ্গবন্ধুকে কেবল একটি ফ্রেমে বাঁধানো
ছবি মনে করে। স্পষ্টতই এরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গত বারো
বছর যে বিপুল সংখ্যক লুটেরা টাকা পাচার করেছে তাদের বেশির ভাগ তো কোন না কোন ভাবে বঙ্গবন্ধুর
নাম পরিচয়ে পরিচিত লোক। অন্য দিকে ক্যাসিনো কান্ড, চাঁদাবাজি, চিকিৎসা জালিয়াতি সহ
বহুমুখী কেলেঙ্কারির অভিযোগে গ্রেফতার প্রায় সবাই তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ফেরিওয়ালা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় বিচারাধীন অধিকাংশই দেশরত্ম শেখ হাসিনা ও জাতির জনকের
অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। ব্যাংক লুটেরাদের একটা বড় অংশ প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
প্রচার করে বেড়ান। কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর গল্প বলেন। এদের বঙ্গবন্ধু প্রেম দেখলে বুঝার
উপায় নেই এরা লুটেরা।
টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার
ক্ষমতায় থাকায় সবাই এখন বঙ্গবন্ধু প্রেমি হয়ে উঠেছেন। যারা এক সময় বঙ্গবন্ধুর নামে
যা খুশি তা বলতো, তারা এখন বঙ্গবন্ধু গবেষক, বহু বই ইতোমধ্যে লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবন
কর্ম নিয়ে। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর এই সময়ে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে বঙ্গবন্ধু
এখন কেবলই ছবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জীবিত থেকেও একটি ছবি হয়ে উঠেছেন। অসংখ্য উদাহরণ
তুলে ধরা যায় এ ব্যাপারে। দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্ব গুণগত মান ক্ষয়ে গেছে, ধসে পড়েছে
পুরোপুরি। কোন সৌন্দর্য সুকুমার বৃত্তি চোখে পড়ে না। মুখস্থ কিছু আওয়াজে বঙ্গবন্ধু,
শেখ হাসিনা নামটি উচ্চারিত হয় মাত্র। এরা শ্লোগান দেয় অথচ ধারণ করে না। বাঙালি জাতীয়তাবোধের
কথা বলে অথচ বাংলার ইতিহাস জানে না। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব কপচায় অথচ উপলব্ধি করে না।
বহু সংসদ সদস্য, মাননীয় মন্ত্রীর চলনে বলনে কর্মকান্ডে বুঝার উপায় নেই এরা একটি ঐতিহ্যের
পরম্পরা সৌন্দর্য বহন করছে। কোথায় কোন বিশেষত্ব
ধরা পড়ে না। মনোনয়ন বাণিজ্য, ভাই ভাস্তে কমিটি তো ওপেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে
মারামারি সংঘাতের ভয়াবহতা প্রমান করে তলানীতে এসে ঠেকেছে দলীয় শৃঙ্খলা। আত্মীয়করণ,
মামা খালু মহল। ফলে অবলীলায় পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছে সব আদর্শ। একদিকে বিস্ময়কর চোখ
ধাঁধানো উন্নয়ন অন্য দিকে ধসে পড়ছে বাঙালির জাতি বোধের স্তম্ভগুলো। আদর্শবিচ্যুতির
ফল ভালো হয় না। সময় বহমান-দেশ ও জাতির স্বার্থে এসব চাটার দলকে চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ
গ্রহণ করার।