All posts by bartaman

প্রবাহ

সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার বিষকণা

ধর্মোন্মাদনার তীব্র জিগিরে !!!

সংলাপ ॥ আমাদের চেতনার যাত্রাটা সম্পূর্ণ সামনের দিকে হয়নি, পিছনের দিকে হয়েছে বেশ খানিকটা। সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার বিষকণা যে ঢুকে গিয়েছে এ দেশের শিরায়, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ বিষকণার উপস্থিতি যতটা ঝাঁঝালো, দু-তিন দশক আগে বা তারও আগে যে ততোটা ছিল না, তাও আজ বেশ বোঝা যায়। শিল্পীর যে জাত-ধর্ম হয় না, সে কথা বাংলাদেশ শতকের পর শতক ধরে জানে। বিষকণাগুলোই বিপদ ডাকছে। এর বিরুদ্ধে এবার একটা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় এসে গেছে। বাংলাদেশের চিরন্তন ঐতিহ্যের বিপরীতে গিয়ে, বাংলার পরম্পরার অমর্যাদা করে, বাংলার সামাজিক বুনটটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যে সব কণ্ঠস্বর প্ররোচনা দেয়ার চেষ্টা করছে, সে সব কণ্ঠস্বরকে সমস্বরে বাধা দিতে হবে। বিষটাকে আর একটুও ছড়াতে দিলে চলবে না। বাধা যদি না দেয়া হয় আজ, বিষকণা কিন্তু অচিরেই বিষবৃক্ষ হয়ে উঠবে। সেদিন বড় সুখের হবে না।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই মত, ধর্মীয় মাহাত্ম্য এমনই যে, যুক্তি যা-ই খাড়া করা হোক না কেন, রাজনীতিকরা তা এড়াতে পারছেন না। ধর্মীয় উন্মাদনা ডেকে আনছে সংঘর্ষ, বিভাজনের রাজনীতি। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। দাঙ্গা হাঙ্গামা বা যে কোনও সংঘাতে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সুতরাং সবার আগে রাজনীতিকদের আরও বেশি করে সংগঠিত করতে হবে এই অংশের মানুষকে। প্রয়োগ করতে হবে শিক্ষা গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য। শ্রমজীবীদের স্বার্থে তাদের আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত নয়, তাদের চিন্তায় যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বাঙালিদের ব্যাপক সংগ্রাম গড়ে তোলার সময় বহমান। ধর্মকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে রাজনীতিক এবং পেশাজীবিদেরকে।

ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতির এত নিবিড় সংযোগ যে সূত্র ধরে তৈরি হয়, সেই যোগসূত্র ধর্মাচরণের জন্য কতটুকুই বা জরুরি, সে সব প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে না।  ধর্ম আর রাজনীতিকে গুলিয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন বহুবার দেশের বহু প্রান্ত থেকে উঠেছে। সদুত্তর কখনওই মেলেনি। ধর্মোন্মাদনার তীব্র জিগিরে জিজ্ঞাসু কণ্ঠস্বরগুলোই ডুবে গিয়েছে বার বার।  ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার হাতছানিতে বাংলা সাড়া দেয়নি এত দিন সে ভাবে। প্রশ্ন তুলেছে বরং সে অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বার বার, কিন্তু ধর্মীয় রাজনৈতিকীকরণের প্রচেষ্টা এবার যখন অত্যন্ত সংগঠিতভাবে শুরু হয়েছে, তখন আগের চেয়েও জোর দিয়ে প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি।

সাংবিধানিকভাবে না মানাক, চোখের অভ্যাসে মানায়। বিরোধী রাজনীতিক-দলগুলোকে এই ধাঁচের কর্মসূচিতেই সবচেয়ে সাবলীল হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত দেশবাসী। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিটা তো কোনও কালেই এই ধাঁচের নয়। তা হলে এ পথে পা বাড়াচ্ছে কেন আওয়ামী লীগ? খেলাটাকে ধর্মীয় ময়দানে নিয়ে যেতে দিচ্ছে কেন আওয়ামী লীগ? রেষারেষিতে নেমে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে বাংলার সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক স্বধর্মে নিধন শ্রেয়, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ এই আপ্তবাক্য স্মরণ রাখা অত্যন্ত জরুরি। যে দিন রাজনীতিকরা এই মেঠো সমস্যা বুঝতে পারবেন, সেদিন দেখা যাবে, দেশটা বদলে গিয়েছে।

নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই সাম্প্রদায়িক রোগে আক্রান্ত

নিরাময় ঘটাতে হবে মানসিক স্থবিরতার

সংলাপ ॥ গলদ রোগ রয়ে যাচ্ছে চেতন জগতের শেকড়েই। সমস্যাটা শেকড়ে বলেই রোগমুক্তিটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওপরে ওপরে চিকিৎসা করে লাভ খুব হবে না, গভীরে গিয়ে নিরাময় ঘটাতে হবে এই মানসিক স্থবিরতার। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি কোনও জাতির বা ভাষার বা ধর্মের বা বর্ণের ঐকান্তিক অধিকার বা পরিচিতি নয়। এই সবই আসলে চলমান সভ্যতার শিক্ষা, প্রতিটি সভ্য মানুষের পরিচিতি, প্রতিটি সভ্য মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট। কিন্তু সে কথা আমরা স্মরণে রাখছি না। সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং সভ্যতার দোহাই পেড়ে উন্মত্তদের থামতে বলছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বার বার বলছেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, অথবা ‘বাংলাদেশে এ সব হয় না’ অথবা ‘বাঙালির সংস্কৃতিতে এ সব নেই’। আমাদের প্রত্যেককে স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর সব সভ্য মাটিই দুর্জয় ঘাঁটি, পৃথিবীর কোনও সভ্য প্রান্তেই এ সব হয় না, পৃথিবীর কোনও সভ্য সংস্কৃতিতেই এ সব নেই। শুধু বাংলাদেশ  খুব উদার, সহিষ্ণু এবং মানবিক আর উপ-মহাদেশের অন্য নানা প্রান্ত অনুদার, অসহিষ্ণু এবং অমানবিক এই ধরনের মন্তব্য বা মতামত বা ভাব প্রকাশের মধ্যেও একটা সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে।

সেটাকে আমরা চিনতে পারি না অনেকেই। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই এই সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। যে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে আজ। অতএব প্রত্যেককে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। কণামাত্র সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বও থাকলে, তারও বিনাশ ঘটাতে হবে। তা হলেই মৌলিক পরিবর্তনটা আসবে। তা হলেই এই অনর্থক এবং বর্বরোচিত অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারব আমরা। বাংলাদেশে এ সব হয় না, বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় না এ জাতীয় সারবত্তাহীন মন্তব্য করে লাভ নেই। কারণ তাতে সঙ্কটমুক্তির কোনও পথ নেই। আমরা যে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি, সেই বার্তাটা চারিয়ে দেয়াই সবচেয়ে জরুরি। একটা বিভাজন যখন রক্তাক্ত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে, তখন বাঙালি আর বাংলাদেশী বা বাঙালি মুসলমান আর মুসলমান বাঙালি বা বাংলা আর না-বাংলার মধ্যে বিভাজনের তত্ত্ব সামনে আনা যে বিচক্ষণতার কাজ নয়, সে কথা বোঝা জরুরি খুবই বিশেষ করে রাজনীতিক সম্প্রদায়ের।

দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, দেশের কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। মসজিদ মন্দির গীর্জা মঠ দরবার আস্তানা আশ্রম যাত্রী সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান।

তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা সমাজের  মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।

সাম্প্রদায়িকতার বা সঙ্কীর্ণতার প্রতিটি বীজকে চিহ্নিত করতে হবে, ছুঁড়ে ফেলতে হবে অস্তিত্বের অনেক দূরে। তার জন্য শুধু কোন এলাকায় নয়, গোটা দেশে শান্তি বহাল রাখার তাগিদ অনুভব করতে হবে। শুধু দেশকে নিয়ে নয়, গোটা পৃথিবীকে নিয়ে ভাবতে হবে। যে দিন সে ভাবে ভাবতে পারবে সবাই, সে দিন আর হয়তো দেখতে হবে না কোনরকম হিংসার পুনরাবৃত্তি।

সমাজ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত যে-ভাবে ব্যক্তিকে নাড়া দেয়, তার চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়, সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়তে পারে কর্মে। ব্যক্তি অনাগত দিনকে কল্পনায় যে-ভাবে আঁকছেন, সেই ছবি বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু একটা বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তি যে কর্মের জন্ম দিচ্ছেন, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে ওই ব্যক্তির তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য থাকে। ব্যক্তির যে কোন শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শিল্প সত্যনিষ্ঠ  তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ। ব্যক্তির নীতি আর ব্যক্তির কর্মের নীতি আলাদা হয়ে গেলে সত্যনিষ্ঠার প্রশ্নে বিচ্যুতি আসবেই, আর কোথাও না কোথাও সে ফাঁকি ধরাও পড়বে।

সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভ-ামির দিকে আঙুল তুলতে পারলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া যায়। ব্যক্তির শিল্পগুণকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তার প্রেরণা-জাগানো কর্মে যে সুস্পষ্ট নৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, ব্যক্তির নৈতিক চেতনা আর তার কর্ম নীতির একাত্মতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানে কতটা পরিবর্তন এসেছিল বা আসছে, তা কতটা অভিপ্রেত ছিল বা আছে, এগুলো নিয়ে নিজের সাথে নিজের বা আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে জীবন ও কর্ম সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেই চলে।

এখন সময় অতন্দ্র প্রহরার

সংলাপ ॥ দেশের মানুষের জাতীয়তাবোধ, বিশ্বাস, ধারণা, অনুভূতি, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিষয়াদি নিয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি উর্দ্ধমুখী হয় রাজনীতিকদের আদর্শিক সামগ্রিক কর্মকা-, কথাবার্তা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা দ্বারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনভাবেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উঠতে পারছে না। পরনিন্দা, পারস্পারিক অশ্রদ্ধা, চরিত্র হনন, অসম্মানই যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে তাদের অসম্মান, কুৎসা রটনা ও নিচু করে জাতির সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দিন দিন উগ্র হচ্ছে। রাজনীতিকরা একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ না ভেবে রাজনৈতিক প্রতিযোগীতা ভেবে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন তাহলে তরুণ, শিক্ষিত ও মেধাবী প্রজন্ম রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আরো আগ্রহী হতেন। কিন্তু রাজনীতিকরা ওই মানুষ গড়ার কারিগর হতে চাচ্ছেন না ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে।

মানুষের উপর আস্থা হারানো অর্থই সংকটে পড়া, জ্ঞানী-গুনীজন এ কথা বলে গিয়েছেন। গণতন্ত্রে আস্থা হারানোকে কি সংকট বলা যাবে? একটা যোগ অবশ্য আছে। অধিকাংশ মানুষের মতের প্রতিফলনে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা, সেটাই তো গণতন্ত্রের উৎস। গণতন্ত্রে আস্থা হারালে মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? বিকল্পগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক, যথা একনায়কতন্ত্র, বা মিলিটারি-রাজ। গণতন্ত্রে বিরোধী দল আবশ্যক। তাদের কাজ শাসকদলের ভুলত্রুটি তুলে ধরা। সংসদ কক্ষে এবং সমাজের সব স্তরে জোরালো ভাষায় সে-কাজ করা সম্ভব। অভিযোগ অসত্য হলে শাসকদল তা খ-ন করবেন, সত্য হলে শুধরে নেবেন। বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, এমন ধারণা যেন না হয়।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোরালো ভাষায় নিজের মতাদি বলে থাকেন। দেশের সাধারণ নাগরিকের মোবাইলে বা টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা একাধিকবার ভেসে আসে। গুরুতর উগ্র হিং¯্র ঘটনার পর তিনি যখন সাময়িক বাক্যহারা হয়ে যান তখন দেশের মানুষ বিভ্রান্ত ও অসহায় বোধ করেন।

শুধুমাত্র সংসদ অচল-সচল হওয়ার কারণে গণতন্ত্রে মানুষ আস্থা রাখবেন না হারাবেন এমন নয়। সাম্প্রতিককালে গণআলোচনায় গণতন্ত্রে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন চিন্তা করেন তাদের মতো দেশের সব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবেন তখন তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ছাড়া আর কিছু বলার নেই, যা কিনা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী। যখনই কোনও দল বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাদের মধ্যে এই প্রবৃত্তি চোখে পড়ে।

মানুষ যখন মত দান করেন তখন যে সর্বদা যথাযথ বিবেচনাবোধ কাজ করে, এমন নয়। কখনও তারা নির্বাচনী প্রচারে বিভ্রান্ত হন, কখনও বা যে শাসকদলের অধীনে আছেন, তাদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অপর কোনও দলকে ক্ষমতার আসনে বসান। মানুষের এই আশা ও আশাভঙ্গের কথা থেকে বলা যায়, দুর্ভাগা সেই জাতি যে নতুন শাসকদলকে জয়ধ্বনি দিয়ে অভ্যর্থনা করে, তারপর বিদায় দেয় ধিক্কারে, আবার অপর এক দলকে জয়ধ্বনি দেয় ক্ষমতায় স্বাগত জানাবে বলে।

১৪২৮ : সত্যানুসন্ধানী হয়ে দেশ গড়ার সময়

সংলাপ ॥ ঐতিহাসিক যাত্রাটা অবশ্য সহজ ছিল না এবং এখনও নয়। আদর্শের প্রতি আনুগত্য অনুরাগ রেখেই বাংলার মানুষ দেশকে সত্যিকার অর্থে মহান করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাঙালির এই দৃঢ়তাবলেই দেশ গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তির কাতারে উঠবে। আদর্শের প্রতি আনুগত্য অনুরাগ রেখেই নতুন প্রজন্মও দেশকে সত্যিকার অর্থে মহান করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই দৃঢ়তাবলেই দেশ গুরুত্বপূর্ণ উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠছে এবং উঠবে।  তিনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বিরাট উচ্চতার এক রাজনৈতিক নেতা, প্রাজ্ঞ সংসদ সদস্য ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী। তাঁর একটাই লক্ষ্য স্থির যে, শুধু দেশের জন্যই কাজ করবেন। কেমন হবে সেই দেশ? সেই দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালিত হবে অবশ্যই এক সুন্দর ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে। গড়ে উঠছে উন্নয়নের নানাবিধ মডেল। গরিব মানুষ, বঞ্চিত নরনারী ও শ্রমিক-কৃষকদের জন্য চলছে অনেক সামাজিক প্রকল্প। অনবদ্য প্রশাসন উপহার দেয়া না হলেও এই সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে হাতিয়ার করে, পরিকাঠামোর বিকাশ ঘটিয়ে আর উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে পর্যাপ্ত লগ্নির মাধ্যমে।

দল পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনবদ্য ভূমিকার কথাও আজ উল্লেখ করার সময় এসেছে। এই কঠোর পরিশ্রমী নেত্রীর সাংগঠনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাঁর যে দূরদৃষ্টি তা খুব কম রাজনীতিকদের মধ্যে দেখা যায়। তৃণমূল স্তরের কর্মীদেরও তিনি উপযুক্ত মর্যাদা দিতে জানেন। বোঝেন, সংগঠনে তাদের এবং নতুন প্রজন্মের অনস্বীকার্য গুরুত্ব। আজ দেশের সব কোণে বিরাটভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, উত্তরণ হয়েছে দেশের বৃহত্তম পার্টিতে, এর পিছনে তাঁর অবদান অপরিমেয়। তাঁর অনবদ্য পরিকল্পনা, কৌশল এবং সেসবের নিখুঁত রূপায়ণ ছাড়া দল এই উচ্চতায় পৌঁছনোর কথা ভাবতেই পারতো না।

আজকের আওয়ামীলীগ শুধু বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোকে আর আঁকড়ে ধরে নেই বরং সংবিধানে জিয়ার বিসমিল্লাহ, জামায়াত ও ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান, হেফাজতে ইসলামের সাথে সমঝোতা, এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম-এর সাংবিধানিকীকরণ, ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু শ্রেণীদের ওপর পরিচালিত নির্যাতনে চোখ উল্টানো, নেপথ্যে দ্বিচারী ভূমিকা পালন এবং সব অঙ্গনে অনেক অপরাধীদের বিচারামলে না আনা প্রভৃতির মাধ্যমে আজকের সরকার নীতি-আদর্শের কোন অবস্থানে বর্তমান তা নিয়ে গবেষণার দাবী রাখে। বিচ্যুতিতে নিপতিত হওয়ার পথে চললে নিকট অতীতের বিএনপি-র জোট সরকারের সাথে তার মৌলিক আদর্শগত গরমিল অন্তর্হিত হয়ে যাবে।

ষ্পষ্টতই বলা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন লড়াইটা আদর্শিক দ্বন্দ্ব বা মতানৈক্যের কারণে নয়, তা পুরোদস্তুর ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়াকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। কোন আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য নয়। বিএনপি এবং বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি  কখনো বিসমিল্লাহ্ প্রশ্নে, জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী অপরাপর দলকে বৈধতা দেয়ার প্রশ্নে, রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে বা সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার না হওয়ার প্রশ্নে সরকারের বিন্দুমাত্র সমালোচনা কি গণমাধ্যমে, কি রাজপথে – কোথাও করেনি।

এ-দেশের বহুত্ববাদের বৈচিত্রকে একটা অখ- ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখা যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নয়, সেটা রাজনৈতিক নেতারা এখনও বুঝতে পারছেন কি? গোটা দেশের উপর অধিকার অর্জনের বাসনা কোন দলের নেতাদের হতেই পারে, সে তো সেই মুঘল আমলে সম্রাট আওরঙ্গজেবও দিল্লিতে বসে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মুঘল সা¤্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলা হয় তাঁর অবাস্তবমুখী নীতি। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের মাটিতে আদর্শিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে, বিভিন্নতার জোটের সঙ্গে আপসকামী টেকসই গণতন্ত্র, দেশ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে এবং আরো দু-এক যুগ রাখতে পারে।

যুগে যগে বাংলাদেশের বুকে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং আছেন, যাঁরা বাঙালি জাতির  কাছে নমস্য এবং যাঁদের দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, কথা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, জাতপাতের বিচার না করা – ইত্যাদি গুণাবলী আজও সাধারণ মানুষকে বাঁচার প্রেরণা জোগায়। এমনই এক আধার হয়ে বাঙালি জাতির মধ্যে বর্তমান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক উত্তরসুরী শেখ হাসিনা। ইচ্ছাশক্তি আর রাজনৈতিক সাধনার বলে বলীয়ান হয়ে তিনি সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছেন দেশনেত্রী। হয়ে উঠেছেন সমাজ পরিবর্তনের পথিকৃৎ। সত্যেরই প্রতিফলন। তিনি কর্ম, দেশভক্তি ও বাঙালিত্ব যোগের এক পবিত্র সমন্বয়। মানুষের সেবায়, তাদের কষ্টে-দুঃখে, দুর্দশায় তাদের পাশে সবসময় দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাঁর অভয়বাণী সাধারণের মাঝে আনে জোরের জোয়ার। তাঁর আশীর্বাদ ও উপদেশে মানুষ হয়েছে বিপন্মুক্ত। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়ে চলছেন। বাংলার মানুষের মঙ্গলচিন্তায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। আদায় করে নিয়েছেন এক সর্বজনীন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। আর তাই তিনি হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক যুগাবতার।

১৪২৮: তোমায় নিয়ে আশাবাদ

সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির স্বপ্নগুলো বাস্তব হোক নতুন বছরে। অন্ধকার ফিকে হোক ক্রমশ, অনাবিল আলোয় ভরে উঠুক বংলাদেশ। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, নেতির জয় কখনও হয়নি। বাঙালি জাতি খাদের কিনার থেকেও বার বার ফিরে এসেছে। তাই চোখে স্বপ্নটা থাক বর্তমান। অন্ধকার কাটিয়ে আলো আনার দায়িত্বটা সকলকেই নিতে হবে। সকলকে নতুন বছরের হার্দিক শুভেচ্ছা। নতুন বছর প্রত্যেকের ভাল কাটুক।

ভাল থাকাটা, ভাল হওয়াটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটা কালো অন্ধকার মেঘ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন একটা বছর সঙ্গে নিয়ে হাজির হবে বৈশাখের সকালে, ১৪২৮ পুরো সময়টা সেই সকালের মতোই ঝকঝকে হয়ে থাকুক,  উজ্জ্বল হয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাক, বৈশাখে থাক এই আশাবাদ।

গত বছরের আবর্জনা দূর হওয়ার প্রত্যাশায়, সর্ব অঙ্গে মলীনতা মেখে আমরা নতুন বছরকে আবাহন করেছি। অতীত ভয় দেখায়। আতঙ্ক তৈরি করে। অন্ধকার বাড়িয়ে দেয়। করোনার থাবায় ১৪২৭ এর পয়লা বৈশাখ জুড়ে ছিল না উৎসব। বারো মাসে তালিকায় বাংলা বছরের প্রথম দিনটা নিজস্ব মহিমায় স্থান করে নিতে না পারলেও হৃদয়ের বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ। আবার বৈশাখ, দেশ জুড়ে নতুন জামা, দোকানে দোকানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ, উষ্ণ আন্তরিকতা ফিওে আসুক নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন যার স্বাদ বছর ভরে চলবে।

দিন বদলের পালায় বাংলা বছর তার গরিমা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। বাংলা বছর এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দিন মাত্র। নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। এ সব আক্ষেপ এত দিনে বাঙালির  গা-সওয়া। কিন্তু হিসেবের নতুন বছরের খাতা খোলার লগ্নে হাতে কী রইল, তা ভুললে চলে না।

একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, কিছু দিন ধরে চার দিকে যে সব কা- ঘটে চলেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ছন্দ যে ভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং খাচ্ছে, যেভাবে ভাবনায় দীর্ঘ ছায়া ফেলছে ভয় এবং অবিশ্বাস, তাতে বাঙালি জাতির গৌরবের ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়টার প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সর্বত্র। বৈশাখেই নিজেদের ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের ঢাক পেটানোর দিনে আত্মসমীক্ষা এবং নিজের বিচার জরুরি।

পরিবর্তন এল, তার সঙ্গী আছে কিছু স্বপ্নও। লোক বিশ্বাস, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু এগারো বছর পেরিয়ে আবার চার পাশে কেমন এক অস্থিরতার বাতাবরণ। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তবে কেন?

সব কিছুতেই রাজনীতি এবং চক্রান্ত দেখতে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বেশ পটু হয়ে উঠছে। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করলেই তাতে কেউ কেউ দ্রুত চক্রান্তের গন্ধ টের পেয়ে যান। যারা শাসকের আসনে থাকেন, গন্ধবিচারের ক্ষমতাও আবার তাঁদেরই বেশি থাকে! নিজেদের কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের জন্য ভুল স্বীকার নেই। দল-মত-রং নির্বিশেষে এটা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ। সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

অসহিষ্ণুতা? কেন এত হিংসা? বাতাসে কেন এত বিষ? আমরা কি পরস্পরের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছি? যাঁরা রাজনৈতিক কান্ডারি, আস্থা ও বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি করার বড় দায়িত্ব কিন্তু তাঁদেরই থাকে। কারণ তাঁরা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে দায়বদ্ধ। সেখানে শিথিলতা ঘটলে বিষয়টি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পর্যবসিত হয়। শরীর শক্তপোক্ত না হলে যেমন রোগ সহজে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়, ব্যাপারটি তেমনই চলমান।

এগারো বছরে অনেকটাই বদলেছে বাংলাদেশের চেহারা। শহর থেকে গ্রাম, সেই বদলের মুখচ্ছবি স্পষ্ট। একের পর এক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষ সরাসরি লাভবান। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আত্মিক ‘উন্নয়ন’ হয়তো প্রকৃত অর্থেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তবু কেন মানুষের এত অবিশ্বাস বাড়ছে রাজনীতিকদের ওপর? শিক্ষিত সমাজের একটু সদিচ্ছা, সততা, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রতিস্পর্ধাহীন মানসিকতা দরকার। ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠার উদারতা। মানুষের গণতন্ত্রে শিক্ষিত সমাজ বড় গুরুত্বপূর্ণ। এতটুকু উদারতা বাঙালি শিক্ষিত সমাজ দেখাতে বদ্ধপরিকর হতে পারলে বাঙালির নববর্ষ সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে উঠবে। যার গর্বিত ভাগীদার হবে সমগ্র জাতি।

গোটা বছর ধরে অনেক রকম সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবাত্মার সাংঘাতিক অসম্মান ঘটিয়ে বাংলার নানা প্রান্তে মাথা তুলেছে হিংসার বিষ। অশান্ত, উত্তপ্ত, রক্তাক্ত হয়ে রইল বাংলার মাটি। গণতন্ত্র নিয়ে রাজনীতিকদের নির্লজ্জ ও বেনজির আঘাত এবং মিথ্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। আরও নানা নেতি হানা দিয়েছে এবং হানা দিতে চাচ্ছে নানা রন্ধ্র পথে।

ইতিবাচক কিছু ঘটেনি গত একটা বছরে, এ কথা বলা যায় না যদিও প্রাণঘাতী করোনার হানায় নাকাল পুরো বিশ্ব। জীবন তার আপন ছন্দ, রূপ, রং, স্পর্শ, আঘ্রাণ নিয়ে নিরন্তর সামনের দিকে নিয়ে চলেছে আমাদের প্রত্যেককেই। শত-সহ¯্র নেতির সাক্ষী হতে হলেও সেই নিরন্তর অগ্রগতিতেই ইতিবাচকতার সবচেয়ে আনন্দ। বছরের শেষ সকালে পৌঁছে খেরো খাতার শেষ পাতায় অগ্রগতির যোগফল থাক, সে যোগফলকে নতুন খাতায় তুলে নেয়ার তোড়জোড় থাকুক দেশবাসীর মধ্যে। নেতির হিসেব ওই শেষ পাতাতেই শেষ হয়ে যাক। বয়ে যেন না নিতে হয় পরের নতুন খাতায়। অঙ্গীকারটা এমনই হোক। দুটো ১৪২৭-১৪২৮ এর মধ্যে অনেকখানি ব্যবধান সঞ্চারিত হোক পৃথিবীর একটা মাত্র আবর্তনকে সাক্ষী রেখে, ১৪২৮-এর শুরুতে অনেক কিছু নতুন আলোয় ধরা দিক, এমনই আকুতি সময়ের চোখে। নতুন বছর বার বারই প্রতীকী তারুণ্য নিয়ে ধরা দেয়। কার্যক্ষেত্রে এ যুগে ইংরেজি নতুন বছরটাই আসল নতুন বছরের তকমা আদায় করে নিয়েছে। বাংলা নববর্ষ কার্যত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। তবু পয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালি মননে স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ, নির্মল অস্তিত্ব নিয়ে ধরা দেয় আজও। অতএব, পয়লা বৈশাখ আজও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ধিক্ষণ, যে সন্ধিক্ষণে জীবনের শপথগুলোকে ঝালিয়ে নেয়া যায় নিষ্কলুষ। অনেক কিছু হয়তো ভুল হয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু হয়তো অনাকাক্সিক্ষত পথে এগিয়েছে, গোলমাল হয়ে গিয়েছে হয়তো অনেক রকম হিসেব গোটা একটা বছর ধরে। সেই সমস্ত ভেস্তে যাওয়া হিসেবের খাতা সপাটে বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে ফেলার অবকাশ এবারেও নিয়ে এসেছে পয়লা বৈশাখ।

‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি’ বাঙালির নববর্ষ ১৪২৮ ভাবনা

বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি।’

একজন খাঁটি বাঙালি কখনো মিথ্যা বলে না।

একজন খাঁটি বাঙালি একজন কুরআনিক মুসলিম।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদের পড়–য়ারা অনেকেই টাকা-পয়সার মোহে সমাজের সর্বস্তরে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিপনার কাজে লিপ্ত রয়েছে – এইসব বিভ্রান্তদের তালিকা তৈরি ও ভালমানুষ করার জন্য সমাজের সবাই এগিয়ে আসি।

বর্তমানে শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী আর সংস্কৃতির নামে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে। তাই প্রতিটি বাঙালির জীবনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ, লালন ও পালন করি।

সকল শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্ম গ্রামে। দেশকে সমৃদ্ধ করতে জন্মস্থান গ্রামের সাথে শহর-নগরের ব্যবধান  কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতদের করা ‘পলিটিক্স’ এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনীতি’ শব্দটির পরিবর্তে দিন বদলের পালায়  ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করি। জননীতি-অর্থাৎ শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগী, সৎ ও মুক্তচিন্তার যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে কাজের সুযোগ করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।

‘সত্য বলি, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, নিজে বাঁচি-দেশ ও জাতিকে বাঁচাই।’

ধৈর্যশীল হয়ে, অন্যের দোষ ক্ষমা করে আল্লাহ্র দরবারে ক্ষমা পাওয়ার প্রার্থী হই।

কর্ম ও চিন্তায় সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের পরিচয় দিই।

প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করি এবং আত্মিক উন্নতি করি।

ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন। তাই কর্ম করি সৃষ্টির সেবাতেই। সেই ফুল হই – যে ফুল প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু ঝরে যায় না। 

সত্যবাণী

ইসলাম জাগো! মুসলিম জাগো! আল্লাহ্ তোমার একমাত্র উপাস্য, কোরআন তোমার সেই ধর্মের, সেই উপাসনার মহাবাণী, – সত্য তোমার ভূষণ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তোমার লক্ষ্য, – তুমি জাগো! মুক্ত বিশ্বের বন্য শিশু তুমি, তোমায় পোষ মানায় কে? দুরন্ত চঞ্চলতা, দুর্দমনীয় বেগ, ছায়ানটের নৃত্য-রাগ তোমার রক্তে, তোমাকে থামায় কে? উষ্ণ তোমার খুন, মস্ত তোমার জিগর, দারাজ তোমার বিল, তোমাকে রুখে কে?  পাষাণ কবাট তোমার বক্ষ, লৌহ তোমার পঞ্জর, অজেয় তোমার বাহু – তোমায় মারে কে? জন্ম তোমার আরবের মহামরুতে, প্রাণ প্রতিষ্ঠা তোমার পর্বত গুহায়, উদাত্ত তোমার বিপুল বাণীর প্রথম উদ্বোধন ‘কোহ-ই তুরের’ নাঙ্গা শিখরে, – তুমি অমর, তুমি চির জাগ্রত। ‘আল্লাহু আকবর’ তোমার ওঙ্কার, আলি তোমার হুঙ্কার, তুমি অজেয়! বীর তুমি, তোমার চিরন্তন মুক্তি, শাশ্বত বন্ধনহীনতা, ‘আজাদীর’ কথা ভুলায় কে? তোমার অদম্য শক্তি, দুর্দমনীয় সাহস, তোমার বুকে খঞ্জর চালায় কে? ইসলাম ঘুমাইবার ধর্ম নয়, মুসলিম শির নত করিবার জাতি নয়। তোমার আদিম জন্মদিন হইতে তুমি বুক ফুলাইয়া, শির উচ্চ করিয়া দুর্লংঘ্য, মহা পর্বতের মত দাঁড়াইয়া আছ, তোমার গগনচুম্বী মিখরে আকাশ-ভরা তারার আলো, অর্ধচন্দ্রের প্রদীপ্ত প্রশান্তি জ্যোতি – তোমার সে মহাগৌরবের কথা বিশ্বে চির-মহিমান্বিত। মনে পড়ে কি, তোমার সেই রক্ত-পতাকা যাহা বিশ্বের সিংহদ্বারে উড়িয়াছিল, তোমার সেই শক্তি যাহা দুনিয়া মথিত আলোড়িত করিয়াছিল? বল বীর, বল আজ তোমার সে শক্তি কোথায়? বল ভীরু, তোমার সে প্রচন্ড উগ্র মহাশক্তিকে কে পদানত করিল? উত্তর দাও। তোমায় আমি আল্লার নামে আহবান করিতেছি, উত্তর দাও! তোমার অপমান কেহ কখনো করিতে পারে নাই, ইসলাম অবমাননা সহে নাই। তুমি সত্য, ইসলাম সত্য, তোমার-আমার বা ইসলামের অপমান যে সত্যের অপমান। তাহা যে সত্য করে, সে ভীরু – সে ক্ষুদ্র। যেদিন তুমি তোমার উদারবাণী মহাশিক্ষা ভুলিয়া স্বাধীনতার বদলে অধীনতার ছায়া মাড়াইতে গিয়াছ সেই দিনই তোমার শিরে মিথ্যা, দুশমনের ভীম প্রহরণ বাজিয়াছে। ইসলাম এক মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাহারো নিকট শির নোয়ায় না। তোমার চির-উচ্চ চির-অটল ঋজু সেই শির আনত করিতে উদ্যত হইয়াছিল, তাই আজ তুমি আঘাত পাইয়াছ, তাই তোমার বক্ষে বজ্রবেদন, শক্তিশেল বাজিয়াছে। যদি আঘাতই খাইয়াছ, যদি আজ এমন করিয়া গভীর বেদনাই তোমার মর্মে বাজিয়াছে, যদি এই প্রথম অবমানিত হইয়াছ, তবে তোমার লাঞ্ছিত সত্য, ক্ষুব্ধ শক্তি আবার উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গের মত উদ্বেলিত হইয়া উঠুক। বল, ইসলাম ভিক্ষা করে না, যাঞা করে না। বল, দুর্বলতা আমাদের ধর্মে নাই। বল, আমাদের প্রাপ্য আমাদের মুক্তি আমরা নিজের শক্তিতে লাভ করিব!

… তোমার বাঁধে ভাঙ্গন ধরিয়াছে, তোমাকে ইহা হইতে রক্ষা পাইতে হইবে। তাই আজ আমরা আমাদের সারা বিশ্বের লাঞ্ছিত বিক্ষুব্ধ শক্তি লইয়া এই মুক্ত মহা-গগন-তলে দাঁড়াইয়া বলিতে চাই – ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’! এই মুক্ত গগনতল তোমার মহাতীর্থস্থান – আরাফাতের ময়দান অপেক্ষাও পবিত্র। এইখানে গৃহহীন পথহারা নিপীড়িত মুসলিম সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব পাইয়াছে, ঈদের দিনের মত পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়াছে, বুকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়াইয়া মুসলিম, আবার বল, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’। যদিও তুমি সর্বস্বহারা হও, কোথাও তোমার মাথা গুঁজিবার ঠাই না থাকে, কুছ পরোয়া নেই, তোমার মাথা নত করিও না। আবার সকলি পাইবে। মুসলিম হীন, এ ঘৃণার কথা শুনিবার পূর্বে কর্ণরন্ধ্রে সিসা ঢালিয়া বধির হইয়া যাও! তোমাদের এই ‘ইখওয়াৎ’কে কেন্দ্র করিয়া আমাদের অন্তরের সত্য স্বাধীন শক্তিকে যেন কোনদিন বিসর্জন না দিই। তোমার বীর ভাইগুলি ঐ যে তোমার দক্ষিণ পার্শ্বে ইসলামের এই শাশ্বত সত্য রক্ষার জন্য হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেছে, সেই শহীদায়েন নব্য তুর্কি-তরুণদের দেখ, আর গৌরবে তোমার বক্ষ ভরিয়া উঠুক। তাহাদের পানে তাকাও, তাহাদের অস্ত্র-ঝঞ্চনা শোনে – তাহাদের হুঙ্কারে তোমার হিম-শীতল রক্ত উষ্ণ হইয়া বহিয়া যাক তোমার শিরায় শিরায়। মেঘ-মুক্ত প্রাবৃট-মধ্যাহ্নের রক্ত ভাস্কর তোমার বিপুল ললাটের ভাস্কর রাজটিকা হউক! তুমি অমর হও! তুমি স্বাধীন হও! তোমার জয় হউক!

চেতনায় বাঙালিত্ব

বাহাদুর বেপারী ॥ আমাদের পরিচয় বাঙালি, আমাদের অহংকার বাঙালিত্ব। আমাদের অস্তিত্বের অংশ মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি। বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা। বাংলার প্রকৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রকৃতি। বাংলার সম্পদ আমাদের মানুষ। বাঙালি  অতিথি পরায়ণ জাতি। এই ভূখন্ড, জাতির ধর্ম কিন্তু ইসলাম না, হিন্দু না, বৌদ্ধ না, খৃষ্টানও না। এর নিজস্ব ধর্ম আছে। এই ধর্মের নাম মানবতা। সেই ধর্মেরই একটি কাজ অতিথি পরায়ণতা। বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু সব ষড়যন্ত্র মুখ থুবরে পড়েছে, বাঙালি পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বারবার। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বজ্র কঠিন, সুকোমল, মহান ডাকে বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে স্বাধীন হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তৎকালীন সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এই বাঙালিরাই। দেড় কোটি বাঙালিকে ঔষধ দিয়ে, অস্ত্র-ট্রেনিং দিয়ে, খাদ্য, আশ্রয় দিয়ে জাগ্রত রেখেছে এই বাঙালিরাই। ওই সীমানা কিন্তু বাংলার বাইরে ছিল না। ওই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যগুলোই ছিল বাঙালি অধ্যুষিত এবং তারাই আমাদের বাঙালিকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সব কিছুই করেছে।

চেতনায় বাঙালিত্ব থাকলে আমরা সবাই সত্যমানুষ। আমরা এখন আছি সত্যমানুষের যুগে। এক হাক্কানী দিবসে তিন ডিজিটের কথা নিশ্চয়ই সবার স্মরণ আছে। পৃথিবী সেই একটি জায়গায় আসতেছে, সত্যমানুষের যুগে। সত্যমানুষকুলের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই ডিজিট ৯৯ ছাড়িয়ে ১০০-তে যাবেই যাবে। তখন এই বাংলা, এই পৃথিবী হবে সত্যমানুষের পৃথিবী। এই বাংলায় অবশ্য-অবশ্যই ৩০ সালে ধর্ম নিয়ে আর ঝামেলা থাকবে না। ৩৮ সালে বাংলার সংসদ হবে সত্যমানুষের সংসদ, ভালো মানুষের সংসদ।

হাক্কানী সত্যব্রত দিবস, সত্য দিবস, আনন্দের দিবস। আমরা আনন্দে-মহাআনন্দে থাকি। আমার সত্য, আপনার সত্য এক হোক। আসুন সত্যকে জেনে নেই, লক্ষ বছরের সত্যের যে ধারাবাহিক ইতিহাস সেটিতো এই হাক্কানীরই ইতিহাস, সত্যব্রত দিবসেরই ইতিহাস সেটি আজ নতুন করে জেনে নেই। পৃথিবীতে এই একটি দিবসে আমার-আপনার সত্যের সাথে একাত্ম হই। সেই সত্যের ধারাবাহিকতা আমাদের চেতনায় থাকুক। আর কোন ভাইরাস যেন আমাদের চেতনায় আঘাত না করে। যার আশীর্বাদ ও কৃপায় থাকি তার কাছে আবেদন, ভাইরাস যেন আমাদের চেতনাকে আর আঘাত করতে না পারে। আমরা আঘাতহীন থাকি, মুক্ত, শূন্য থাকি। বাঙালিত্বকে ধারণ করি, বাঙালিত্বই হোক আমাদের চেতনা আর এই চেতনার মাধ্যমে হই আমরা সত্যমানুষ। আর ‘ক্বুন-ফাইয়াক্বুন’-এর আশীর্বাদে থাকি। এই আশীর্বাদে থাকলেই পৃথিবী হবে সুন্দর, আমরা হবো সুন্দর, সবাই হবো ভালো মানুষ। আর আমরা সমর্পণ করি আমাদের সকল কর্মকা- এই সকল সত্যমানুষের কাছে। বাংলাদেশ সুন্দর হোক, ভালো হোক। অনেক সুন্দর হয়েছে, অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সংখ্যা বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদ, বেড়েছে মাদকাসক্তির সংখ্যা। যে কোন সময় বিপর্যয় ঘটতে পারে, আর সেই বিপর্যয়কে সামনে রেখে সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ একদিন বলেছেন, এই বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিকে সাসটেইনেবল করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষাকে সুন্দর করতে হবে। নচেৎ যে অবস্থা শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের ঘর-সংসার আর পারিবারিক জীবন ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। আর কিছু লোভী চক্র বের হয়েছে যারা এই জনপদের মানুষের একটু জায়গা-জমিনের প্রবলেম থাকলে সেখানে আঘাত হানে। একদিন নির্বাচনী ক্যাম্পিং-এ যাওয়ার সময় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা আমাকে বললেন, তোর নাম আমি জানি বাহাদুর। তোর দুইটি কাজ, যারা গাজা খায় তাদের মেরে ফেলবি আর যে মানুষের জমি দখল করে, যার জমি তাদের ফিরায়ে দিতে হবে। জায়গা-জমি জোরদখল, বিবাহ-বিচ্ছেদ আর মাদকাসক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে সামাজিক বিপর্যয় ঘটছে, সে বিপর্যয় থেকে জাতি মুক্তি পাক। বাঙালি শ্রেষ্ঠ জাতি, তার পরিচয় হতে হবে চিন্তা ও কর্মে। পৃথিবীর এমন কোন রাষ্ট্র তৈরি হয় নি যেখানে বাঙালির উপস্থিতি ছিল না। যে রেড ইন্ডিয়ান জাতির কথা বলা হয়, প্রমাণ হয়েছে তারাও বাঙালি। আমেরিকা স্বাধীন করেছে বাঙালি।

মালদ্বীপে বাস করে এক ছেলে তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, বললো – দুই লক্ষ মালদ্বীপবাসীর মধ্যে এক লক্ষ বাঙালি, তারা মুসলমান। জিজ্ঞেস করলাম তাহলে কতো অংশ বাঙালি, বললো আসলেতো সাংঘাতিক ব্যাপার। বাঙালির কি আছে, জিজ্ঞাসা করাতে ছেলেটি ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র, চিন্তায় পড়ে গেছে, বললো বাংলায় বাজার করা যায়, মাছ, গাছ পানি এগুলো বাংলা শব্দ, প্রকৃতি দেখি বাংলায়, বলে খুব খুশি। ভুলে গেলে চলবে না, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে যে পানি গড়ায়ে বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যেখানেই গিয়ে পড়েছে সেটাই বাংলা। হোক সে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা শ্রীলংকা আর মালদ্বীপ সবই বাংলা। সৃষ্টিকর্তার কোন ইচ্ছা ছিল বলেই প্রকৃতির এই খেলায় বাংলার জল, আলো-বাতাস পেয়ে এগুলো বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভৌগলিকভাবে যারই দখলে থাক না কেন বাংলারই অঞ্চল।

নবী মোহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত) যদি এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে বেহেশতের ফল হতো আম, লিচু, কাঁঠাল, দুধের নহর হতো বাংলা। বেহেশতের যে দুধের নহরের কথা বলা হয়েছে, উটে আর কতটুকু দুধ হয়! আরবেতো দুধের নহর নেই, বাংলায়তো দুধে ভরপুর। ওইটারতো অভাব ছিল তাদের, এজন্য দুধের নহর থাকবে বেহেশতে মানে ভবিষ্যৎকাল। আর আমাদের এই বাংলায় বর্তমানেই আছে বেহেশতী সকল কিছু প্রাকৃতিকভাবে। যে কোন ফলই আমরা খাই সব ফাটাফাটি বিশে^র আর কোথাও এমন সুস্বাদু নাই। কাঁঠালতো সর্ব রোগের মহৌষধ। বাংলার ফল-ফুলই শুধু নয়। আউশ ধানের মার (গ্রামে ভাতের ফেন বলে) যে সুস্বাদু খেলে আর কিছু লাগে না। ব্রিটেন থেকে আসা আমার পরিচিত ভাই বলছেন ব্রিটেনে এক বাটি ভাতের স্যুপ বিক্রি হয় ১০ পাউন্ডে, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় বারশত টাকা। বাংলার কোন কিছুই ফেলনা না। বাঙালি জাতি হিসেবেও ফেলনা না। বারবার বহি:শত্রু দ্বারা আমরা আক্রান্ত হয়েছি, অনেকে বলেছে এরা ফেলনা, এদের থেকে সব নিংড়ে নিতে হবে। কিন্তু বাংলার সম্পদ অফুরন্ত, শেষ হবার নয়, বাঙালি বীরের জাতি বারবার সব বাধা প্রতিহত করে প্রমাণ করেছে। সাধককুল বলে তোমরা পশ্চাদপদ নও, সত্যের সাথে যুক্ত হও। সত্য হতে সরে যেও না। বাংলাতো সাধককুলের আশীর্বাদধন্য। অসংখ্য সাধক শুয়ে আছেন এই মাটিতে। তোমরা আলোর সাথে যুক্ত হও। সেই আলো যদি হয় বিশাল বড় পাওয়ার হাউজ, তাহলে তো বাঙালি হবেই হবে আলোকিত। আবার ধারণ করার ক্ষমতা যদি না থাকে তো অবশ্যই বার্স্ট হয়ে যাবে। ধারণ করার জন্য ধীরে ধীরে তৈরি করা হয়। সময় ও কর্মের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় বাঙালি, সে সাধকেরই আশীর্বাদ। আমরা চাই হক-হক হাক্কানী, তুমি কে, আমি কে বাঙালি-বাঙালি। আসুন সবাই মিলে আমরা বলি, জয় হোক হাক্কানীর, জয় হোক বাংলার, জয় হোক বাঙালিত্বের। জয় হোক, মুক্ত হোক আমার চেতনা। আমার চেতনায় আর ভাইরাস না থাকুক। আমার লক্ষ বছরের এই মেধা শূন্য থাকুক, যেমন ইচ্ছা, তেমন করে আমরা খেলবো, গড়বো সত্যমানুষের অনুস্মরণ করে। জয় হোক সত্যমানুষের।

১৪২৮: তোমায় নিয়ে আশাবাদ

সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির স্বপ্নগুলো বাস্তব হোক নতুন বছরে। অন্ধকার ফিকে হোক ক্রমশ, অনাবিল আলোয় ভরে উঠুক বংলাদেশ। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, নেতির জয় কখনও হয়নি। বাঙালি জাতি খাদের কিনার থেকেও বার বার ফিরে এসেছে। তাই চোখে স্বপ্নটা থাক বর্তমান। অন্ধকার কাটিয়ে আলো আনার দায়িত্বটা সকলকেই নিতে হবে। সকলকে নতুন বছরের হার্দিক শুভেচ্ছা। নতুন বছর প্রত্যেকের ভাল কাটুক।

ভাল থাকাটা, ভাল হওয়াটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটা কালো অন্ধকার মেঘ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন একটা বছর সঙ্গে নিয়ে হাজির হবে বৈশাখের সকালে, ১৪২৮ পুরো সময়টা সেই সকালের মতোই ঝকঝকে হয়ে থাকুক,  উজ্জ্বল হয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাক, বৈশাখে থাক এই আশাবাদ।

গত বছরের আবর্জনা দূর হওয়ার প্রত্যাশায়, সর্ব অঙ্গে মলীনতা মেখে আমরা নতুন বছরকে আবাহন করেছি। অতীত ভয় দেখায়। আতঙ্ক তৈরি করে। অন্ধকার বাড়িয়ে দেয়। করোনার থাবায় ১৪২৭ এর পয়লা বৈশাখ জুড়ে ছিল না উৎসব। বারো মাসে তালিকায় বাংলা বছরের প্রথম দিনটা নিজস্ব মহিমায় স্থান করে নিতে না পারলেও হৃদয়ের বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ। আবার বৈশাখ, দেশ জুড়ে নতুন জামা, দোকানে দোকানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ, উষ্ণ আন্তরিকতা ফিওে আসুক নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন যার স্বাদ বছর ভরে চলবে।

দিন বদলের পালায় বাংলা বছর তার গরিমা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। বাংলা বছর এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দিন মাত্র। নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। এ সব আক্ষেপ এত দিনে বাঙালির গা-সওয়া। কিন্তু হিসেবের নতুন বছরের খাতা খোলার লগ্নে হাতে কী রইল, তা ভুললে চলে না।

একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, কিছু দিন ধরে চার দিকে যে সব কা- ঘটে চলেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ছন্দ যে ভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং খাচ্ছে, যেভাবে ভাবনায় দীর্ঘ ছায়া ফেলছে ভয় এবং অবিশ্বাস, তাতে বাঙালি জাতির গৌরবের ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়টার প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সর্বত্র। বৈশাখেই নিজেদের ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের ঢাক পেটানোর দিনে আত্মসমীক্ষা এবং নিজের বিচার জরুরি।

পরিবর্তন এল, তার সঙ্গী আছে কিছু স্বপ্নও। লোক বিশ্বাস, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু এগারো বছর পেরিয়ে আবার চার পাশে কেমন এক অস্থিরতার বাতাবরণ। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তবে কেন?

সব কিছুতেই রাজনীতি এবং চক্রান্ত দেখতে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বেশ পটু হয়ে উঠছে। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করলেই তাতে কেউ কেউ দ্রুত চক্রান্তের গন্ধ টের পেয়ে যান। যারা শাসকের আসনে থাকেন, গন্ধবিচারের ক্ষমতাও আবার তাঁদেরই বেশি থাকে! নিজেদের কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের জন্য ভুল স্বীকার নেই। দল-মত-রং নির্বিশেষে এটা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ। সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

অসহিষ্ণুতা? কেন এত হিংসা? বাতাসে কেন এত বিষ? আমরা কি পরস্পরের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছি? যাঁরা রাজনৈতিক কান্ডারি, আস্থা ও বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি করার বড় দায়িত্ব কিন্তু তাঁদেরই থাকে। কারণ তাঁরা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে দায়বদ্ধ। সেখানে শিথিলতা ঘটলে বিষয়টি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পর্যবসিত হয়। শরীর শক্তপোক্ত না হলে যেমন রোগ সহজে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়, ব্যাপারটি তেমনই চলমান।

এগারো বছরে অনেকটাই বদলেছে বাংলাদেশের চেহারা। শহর থেকে গ্রাম, সেই বদলের মুখচ্ছবি স্পষ্ট। একের পর এক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষ সরাসরি লাভবান। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আত্মিক ‘উন্নয়ন’ হয়তো প্রকৃত অর্থেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তবু কেন মানুষের এত অবিশ্বাস বাড়ছে রাজনীতিকদের ওপর? শিক্ষিত সমাজের একটু সদিচ্ছা, সততা, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রতিস্পর্ধাহীন মানসিকতা দরকার। ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠার উদারতা। মানুষের গণতন্ত্রে শিক্ষিত সমাজ বড় গুরুত্বপূর্ণ। এতটুকু উদারতা বাঙালি শিক্ষিত সমাজ দেখাতে বদ্ধপরিকর হতে পারলে বাঙালির নববর্ষ সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে উঠবে। যার গর্বিত ভাগীদার হবে সমগ্র জাতি।

গোটা বছর ধরে অনেক রকম সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবাত্মার সাংঘাতিক অসম্মান ঘটিয়ে বাংলার নানা প্রান্তে মাথা তুলেছে হিংসার বিষ। অশান্ত, উত্তপ্ত, রক্তাক্ত হয়ে রইল বাংলার মাটি। গণতন্ত্র নিয়ে রাজনীতিকদের নির্লজ্জ ও বেনজির আঘাত এবং মিথ্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। আরও নানা নেতি হানা দিয়েছে এবং হানা দিতে চাচ্ছে নানা রন্ধ্র পথে।

ইতিবাচক কিছু ঘটেনি গত একটা বছরে, এ কথা বলা যায় না যদিও প্রাণঘাতী করোনার হানায় নাকাল পুরো বিশ্ব। জীবন তার আপন ছন্দ, রূপ, রং, স্পর্শ, আঘ্রাণ নিয়ে নিরন্তর সামনের দিকে নিয়ে চলেছে আমাদের প্রত্যেককেই। শত-সহ¯্র নেতির সাক্ষী হতে হলেও সেই নিরন্তর অগ্রগতিতেই ইতিবাচকতার সবচেয়ে আনন্দ। বছরের শেষ সকালে পৌঁছে খেরো খাতার শেষ পাতায় অগ্রগতির যোগফল থাক, সে যোগফলকে নতুন খাতায় তুলে নেয়ার তোড়জোড় থাকুক দেশবাসীর মধ্যে। নেতির হিসেব ওই শেষ পাতাতেই শেষ হয়ে যাক। বয়ে যেন না নিতে হয় পরের নতুন খাতায়। অঙ্গীকারটা এমনই হোক।

দুটো ১৪২৭-১৪২৮ এর মধ্যে অনেকখানি ব্যবধান সঞ্চারিত হোক পৃথিবীর একটা মাত্র আবর্তনকে সাক্ষী রেখে, ১৪২৮-এর শুরুতে অনেক কিছু নতুন আলোয় ধরা দিক, এমনই আকুতি সময়ের চোখে। নতুন বছর বার বারই প্রতীকী তারুণ্য নিয়ে ধরা দেয়। কার্যক্ষেত্রে এ যুগে ইংরেজি নতুন বছরটাই আসল নতুন বছরের তকমা আদায় করে নিয়েছে। বাংলা নববর্ষ কার্যত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। তবু পয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালি মননে স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ, নির্মল অস্তিত্ব নিয়ে ধরা দেয় আজও। অতএব, পয়লা বৈশাখ আজও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ধিক্ষণ, যে সন্ধিক্ষণে জীবনের শপথগুলোকে ঝালিয়ে নেয়া যায় নিষ্কলুষ। অনেক কিছু হয়তো ভুল হয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু হয়তো অনাকাক্সিক্ষত পথে এগিয়েছে, গোলমাল হয়ে গিয়েছে হয়তো অনেক রকম হিসেব গোটা একটা বছর ধরে। সেই সমস্ত ভেস্তে যাওয়া হিসেবের খাতা সপাটে বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে ফেলার অবকাশ এবারেও নিয়ে এসেছে পয়লা বৈশাখ।

শান্তির জন্য ‘সূফী ইসলাম’ ডাক দিয়ে যায়

শাহ্ ফুয়াদ ॥ অসংখ্য সূফী সাধক-অলি-আউলিয়া-দরবেশের পূণ্য কর্মে এদেশে শান্তির বার্তা হিসেবে এসেছিল ইসলাম ধর্ম। কিন্তু ইসলাম নিয়ে এ বাংলায় রাজনীতি নতুন নয়। ১৯৭১ সালের এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মানুষ দেখেছিল ধর্মের নামে কী জঘন্য কাজ করেছিল এদেশেই জন্ম নেয়া পাপীষ্ঠ কিছু কিছু মানুষ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেদিন ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা, নারী নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল ধর্মব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার অবকাশ এ লেখায় নেই। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর ক্ষমতায় জুড়ে বসা পাকিস্তানী শাসকচক্র তাদের রাজনৈতিক তথা কায়েমী স্বার্থে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহারের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে বসে এবং এর অপব্যবহার করতে থাকে। সদ্য জন্মলাভকারী পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমী স্বার্থে ব্যবহারের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠে এই পবিত্র ইসলাম ধর্ম । এই ধর্মব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা পাকিস্তানী শাসকচক্র ছিলো একে অপরের পরিপূরক।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও দেশবাসী যখন আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে তখন পাকিস্তানী শাসনামলের সেই দিনগুলো কীভাবে মূল্যায়ন বা উপলব্ধি করবে বা করতে পারছে নতুন প্রজন্ম তা হয়তো গবেষণার বিষয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সেই ঘৃণ্য ধর্মব্যবসায়ীরা এখনো সমাজের সব স্তরের মানুষকে মিথ্যার বেড়াজালে আটকে রেখে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধার করে আরাম-আয়েশ করে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি ঢাকার বাইতুল মোকাররাম মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও সরাইলে এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে যেভাবে রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে তা ধর্মব্যবসায়ীদের ১৯৭১’এর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডেরই নতুন রূপ। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বিলাসবহুল রিসোর্টে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তথাকথিত হেফাজত নেতাকে জনতার হাতে হাতেনাতে আটককে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃস্টি হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হেফাজত নেতার প্রতি একশ্রেণীর মানুষের অন্ধভক্তির কারণে তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, তাদের নেতা এমন কাজ করতে পারে। ধর্মভীরুতা থেকে ধর্মান্ধতার রূপ কেমন হতে পারে, মিথ্যাচারে এরা কতটুকু পারঙ্গমতা, দক্ষতা অর্জন করেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও মানুষের প্রতিক্রিয়া এর একটি উদাহরণ মাত্র।

 অথচ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেরও বহু  আগে এদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে যার যার ধর্ম পালন করে এসেছে যা ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এবং তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এই বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের প্রায় দুই শ’ বছর (১৩৩৮-১৫৩২) মুসলিম সুলতানগণ ক্ষমতায় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা সব ধর্মের মানুষের প্রতি ছিলেন সহনশীল। এক্ষেত্রে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪২), আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ (১৪৯২-১৫১৯), নূসরত শাহ্, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের (১৫১৯-১৫৩২) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের সময়ে বাংলার মান-মর্যাদা- গৌরব উচ্চ শিখরে উঠেছিল যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই সুলতানগণ সুফী-দরবেশ-আউলিয়াদেরকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন এবং তাঁরা বিভিন্ন স্থানে সূফীদের জন্য দরবার শরীফ-খানকা শরীফ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন, পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময় শ্রীচৈতন্য বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সূফী-দরবেশদের প্রতি সুলতানের সম্মানবোধ ও আচরণ শ্রীচৈতন্যকে তাঁর ধর্ম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেছিলো বলে বাউল ধর্মমতাবলম্বী অনেকে মত ব্যক্ত করে থাকেন। ন্যায়বিচারক সুলতান হিসেবে সমধিক খ্যাতির অধিকারী গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে আজও বর্তমান। মূলত বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তভিত্তিটা সুলতানী আমলেই তৈরি হয়েছিল।   

বাংলায় সূফী-দরবেশদের প্রচারিত ধর্মের মূলে ছিল মানবতাবাদ। ফলে অন্যান্য ধর্ম বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের জাতি-ভেদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে নি¤œ বর্ণের নিষ্পেষিত মানুষেরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় স্থান করে নিয়েছিল। তবে সূফীদের ইসলামের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজ শাসন। কারণ, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল এদেশের ফকীর-দরবেশ-সন্নাসীরাই। এঁদেরই প্রধান ফকির ফজনু শাহ নামটি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও পরে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার কোলকাতা ও ঢাকায় আলিয়া মাদ্রাসার মতো অসংখ্য মাদ্রাসা ভারবর্ষে  প্রতিষ্ঠা করে তাদেরই মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করে এবং অসংখ্য মৌলভী তৈরি করে সর্বত্র প্রেরণ করে। ইসলাম ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ (ফতোয়া) তখন থেকেই ইংরেজ শাসকদের অনুকূলে যেতে শুরু করে। ফলে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো মোল্লা-মৌলভী কথা বলেছেন এমন ঘটনা পাওয়া যায় না। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃস্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটো রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রেও একই দৃশ্যপট-বরং আরও শক্তিশালী হয়ে এই ধর্মব্যবসায়ীরা বিশেষ করে পূর্ববাংলার জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদর-আলশাম্স এবং পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংসতাই এর প্রমাণ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ণ, নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে দিতে পাকিস্তানীরা ইসলাম ধর্ম এবং এর নবীজীকে কীভাবে ব্যবহার করতো তার তার একটি উদাহরণ তুলে ধরে হলো। মহাকালের অগ্নিপুরুষ সূধী সাধক মওলানা ভাসানী তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক (জেনারেল সেক্রেটারি)। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেদিন ‘প্রতিরোধ দিবসে’র ডাক দিলো সেদিনটিতে সরকারের মদদপুস্ট হয়ে একটি গ্রুপ ভারতের কাশ্মীরে নবীজির অবমাননা হয়েছে বলে অন্য কর্মসূচি নিয়ে আসলো। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বিবৃতিতে (দৈনিক আজাদে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত) ঘটনাটি ‘ প্রতিরোধ দিবস প্রসঙ্গ জনাব মুজিবর রহমান কর্ত্তৃক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ’ শিরোনামের খবরে ঘটনাটি ফুটে উঠেছে এভাবে-“করাচী, ১লা ফেব্রুয়ারী।- পূর্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান এম, সি, এ অদ্য নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়াছেন: ‘গত ২৯শে জানুয়ারী “প্রতিরোধ দিবস” পালন সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে যে বিবরণী প্রকাশিত হইয়াছে তাহা পাঠ করিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। এই সকল সংবাদে ২৯শে জানুয়ারী তারিখের “প্রতিরোধ দিবস” পালন সম্পর্কে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হইয়াছে। প্রায় ১৫ দিন পূর্ব্বে মওলানা ভাসানী এই দিবস পালনের কথা ঘোষণা করেন এবং এই সম্পর্কে প্রস্তুতিমূলক কার্য্য যখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছে, তখন কিছু সংখ্যক লোক ভারতে এক শ্রেণীর সংবাদপত্র কর্ত্তৃক হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে অবমাননাকর ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের তারিখ হিসাবে উক্ত দিনটিকেই বাছিয়া লন। হজরত মোহাম্মদের প্রতি এইরূপ জঘন্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন সম্পর্কিত এইরূপ একটি সভার প্রতি আমাদের অবশ্য পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তারিখ ও সময় নির্দ্ধারণের ব্যাপার দেখিয়াই আমাদের মনে গভীর সন্দেহ জাগে। কারণ, কিছু সংখ্যক লোক যে জনসাধারণের মনোভাবের সুযোগ লইয়া আমাদের উদ্দেশ্য পন্ড করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়া থাকে, এইরূপ অভিজ্ঞতা অতীতেও আমরা লাভ করিয়াছি।- এ, পি, পি।

উল্লেখ্য, ইতিহাসে দেখা যায়, পাকিস্তানী শাসন-শোষণে এবং তৎকালীন পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল এবং এই অবস্থানের অবসানে প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এই ‘প্রতিরোধ দিবস’এর ডাক দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘এই কিছুসংখ্যক লোক’ই যে ধর্মব্যবসায়ী এবং সরকারের লোক সেটি বুঝতে সচেতন কোনো মানুষেরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অত্যন্ত প্রতাপশালী পাকিস্তানী শাসকচক্র ও ধর্মজীবী-ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের ভাষাটুক ব্যক্ত করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই ধর্মব্যবসায়ীরা এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরা পেরে উঠে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। এদের মুখোশও উন্মোচিত হয়েছিল। যদিও এদের কেউ এখন আর রাজাকার পরিচয় দিতে চায় না। 

কিন্তু ‘চোরে না-শুনে ধর্মের কাহিনী।’ তাই তারা ধর্মের নামে অধর্মের কাজ করতে কখনও থেমে থাকেনি।  আজও ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন লেবাস পরে ‘এই কিছু সংখ্যক লোক’ বাংলাদেশের মানুষের শান্তি বিনষ্ট করতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল অর্জন ধূলিসাৎ করে দিতে দেশি-বিদেশি অপশক্তির ইন্ধনে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধার নানা ফাঁক-ফোকরে ‘ এই কিছু সংখ্যক লোক’ আরও হৃষ্টপোষ্ট হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ২১ বার হত্যার প্রচেস্টা চালিয়েছে। এদের আরও যতসংখ্যক  ষড়যন্ত্র যা সচেতন দেশবাসী কারোরই অজানা নয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে পাকিস্তানী ও সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট ধর্মব্যবসায়ীরা কতটুকু কদাচার  দেখাতে পারে তার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ এবার দেখা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এদের এক নেতার মুখোশ উন্মোচন হলো সোনারগাঁওয়ের হোটেলে। এদের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৩ জন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটলো। নিহত এসব পরিবারের লোকদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি থাকলে কেউ এইসব হোটেলে এভাবে যেতে পারে না। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে তাদেরই পৃষ্ঠপোষতায় তৈরি কোনো মাদ্রাসায় সূফীতত্ত্বের তথা মানবতাদের চর্চা হবে, দেশ ও মানুষের পক্ষে কথা বলবে, ধর্মের শান্তি ও সত্যের বাণী তুলে ধরবে সমাজ ও দেশের কলাণে এমনটি আশা করা পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিগত ২০/২৫ বছর ধরে সারা দেশের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও শত শত মাদ্রাসা সৃস্টির পেছনে কী উদ্দেশ্য, এসবে কী ধর্মের কী পড়ানো হয়, এসব থেকে পাশ করা ছাত্র’ছাত্রীরা দেশ-জাতি-ধর্ম এমনকি নিজের কল্যাণে কী ভূমিকা ও পালন করছে -এসব বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের কোনোই বক্তব্য নেই। তবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাধারণ মানুষ তথা মানবতার কল্যাণে এসব মাদ্রাসা কী কাজ করছে তা সচেতন ও বিবেকবান মানুষেরা ঠিকই বুঝতে পারছেন। ভোগবাদী এইসব খারেজী ধর্মব্যবসায়ীকে ধর্মের কাজ থেকে যতদূরে রাখা যাবে ততই মঙ্গল বলে অভিমত দিচ্ছেন বিবেকবান মহল।  উল্লেখ্য, সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে ইসলামের মর্মবাণী প্রথম প্রচারিত হয়েছিল আজ থেকে ৭ শ’ বছর আগে। খড়মপুরে সূফী সাধক সৈয়দ আহমদ গেছু দরাজ বা শাহ্ পীর (কল্লা শহীদ), শাহজাদাপুরে সূফী সাধক শাহ্ রুকুনউদ্দিন আনসারীএঁর পবিত্র দরগাহ এই ইতিহাসের উজ্জলতম নিদর্শন। শাহজাদাপুর গ্রামে বড় বড় কয়েকটি দীঘি আজও প্রমাণ করে সূফী সাধকগণ জনহিতকর কাজে কীভাবে নিজের নিজের জীবনকে ব্যয় করেছিলেন। আর আজ থেকে ৫ শ’ বছর আগে দিল্লির মোগল শাসন থেকে বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ঈশা খাঁর পিতা কালীদাস গজদানী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তরফ-বিজেতা আউলিয় সৈয়দ নাসিরউদ্দিনের প্রপৌত্র সৈয়দ ইব্রাহীমএঁর কাছে। সৈয়দ ইব্রাহীম খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিলেন। বিদ্যার্জন করে তিনি বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্ (১৪১৫-১৪৩১) থেকে মালেকউল উলামা উপাধিপ্রাপ্ত হন। (হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, পৃ.৩০)। অর্থাৎ, এ অঞ্চলে সূফী ইসলামের প্রবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং তাঁরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। তাঁদের দরগাহ আজও সব ধর্মের, সর্বস্তরের মানুষের, শান্তি ও মঙ্গলের প্রত্যাশীদের মিলনকেন্দ্র। তখন এই অঞ্চলে কোনো মাদ্রাসা-মসজিদ ছিল না। অথচ আজ এত মাদ্রাসা-মসজিদ থাকা সত্ত্বেও নিজের দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের জনকের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সময়ে এত অশান্তি-হানাহানির কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে-দেশকে এগিয়ে নিতে হলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সূফী সাধকদের প্রচারিত ইসলামের মর্মবাণী প্রচারে আজকের দিনের মাদ্রাসা-মসজিদ-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে সরকার ও প্রশাসন এবং সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে-এটিই আজ দেখতে চায় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা।

সময়ের সাফ কথা…. নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা

অনেক বাঙালিই সাম্প্রদায়িক রোগে আক্রান্ত নিরাময় ঘটাতে হবে মানসিক স্থবিরতার

সংলাপ ॥ গলদ রোগ রয়ে যাচ্ছে চেতন জগতের শেকড়েই। সমস্যাটা শেকড়ে বলেই রোগমুক্তিটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওপরে ওপরে চিকিৎসা করে লাভ খুব হবে না, গভীরে গিয়ে নিরাময় ঘটাতে হবে এই মানসিক স্থবিরতার। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি কোনও জাতির বা ভাষার বা ধর্মের বা বর্ণের ঐকান্তিক অধিকার বা পরিচিতি নয়। এই সবই আসলে চলমান সভ্যতার শিক্ষা, প্রতিটি সভ্য মানুষের পরিচিতি, প্রতিটি সভ্য মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট। কিন্তু সে কথা আমরা স্মরণে রাখছি না। সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং সভ্যতার দোহাই পেড়ে উন্মত্তদের থামতে বলছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বার বার বলছেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, অথবা ‘বাংলাদেশে এ সব হয় না’ অথবা ‘বাঙালির সংস্কৃতিতে এ সব নেই’। আমাদের প্রত্যেককে স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর সব সভ্য মাটিই দুর্জয় ঘাঁটি, পৃথিবীর কোনও সভ্য প্রান্তেই এ সব হয় না, পৃথিবীর কোনও সভ্য সংস্কৃতিতেই এ সব নেই। শুধু বাংলাদেশ  খুব উদার, সহিষ্ণু এবং মানবিক আর উপ-মহাদেশের অন্য নানা প্রান্ত অনুদার, অসহিষ্ণু এবং অমানবিক এই ধরনের মন্তব্য বা মতামত বা ভাব প্রকাশের মধ্যেও একটা সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। সেটাকে আমরা চিনতে পারি না অনেকেই। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই এই সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। যে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে আজ। অতএব প্রত্যেককে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। কণামাত্র সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বও থাকলে, তারও বিনাশ ঘটাতে হবে। তা হলেই মৌলিক পরিবর্তনটা আসবে। তা হলেই এই অনর্থক এবং বর্বরোচিত অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারব আমরা। বাংলাদেশে এ সব হয় না, বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় না এ জাতীয় সারবত্তাহীন মন্তব্য করে লাভ নেই। কারণ তাতে সঙ্কটমুক্তির কোনও পথ নেই। আমরা যে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি, সেই বার্তাটা চারিয়ে দেয়াই সবচেয়ে জরুরি। একটা বিভাজন যখন রক্তাক্ত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে, তখন বাঙালি আর বাংলাদেশী বা বাঙালি মুসলমান আর মুসলমান বাঙালি বা বাংলা আর না-বাংলার মধ্যে বিভাজনের তত্ত্ব সামনে আনা যে বিচক্ষণতার কাজ নয়, সে কথা বোঝা জরুরি খুবই বিশেষ করে রাজনীতিক সম্প্রদায়ের।

দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, দেশের কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। মসজিদ মন্দির গীর্জা মঠ দরবার আস্তানা আশ্রম যাত্রী সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান।

তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা সমাজের  মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।

সাম্প্রদায়িকতার বা সঙ্কীর্ণতার প্রতিটি বীজকে চিহ্নিত করতে হবে, ছুঁড়ে ফেলতে হবে অস্তিত্বের অনেক দূরে। তার জন্য শুধু কোন এলাকায় নয়, গোটা দেশে শান্তি বহাল রাখার তাগিদ অনুভব করতে হবে। শুধু দেশকে নিয়ে নয়, গোটা পৃথিবীকে নিয়ে ভাবতে হবে। যে দিন সে ভাবে ভাবতে পারবে সবাই, সে দিন আর হয়তো দেখতে হবে না কোনরকম হিংসার পুনরাবৃত্তি।

সমাজ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত যে-ভাবে ব্যক্তিকে নাড়া দেয়, তার চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়, সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়তে পারে কর্মে। ব্যক্তি অনাগত দিনকে কল্পনায় যে-ভাবে আঁকছেন, সেই ছবি বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু একটা বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তি যে কর্মের জন্ম দিচ্ছেন, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে ওই ব্যক্তির তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য থাকে। ব্যক্তির যে কোন শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শিল্প সত্যনিষ্ঠ  তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ। ব্যক্তির নীতি আর ব্যক্তির কর্মের নীতি আলাদা হয়ে গেলে সত্যনিষ্ঠার প্রশ্নে বিচ্যুতি আসবেই, আর কোথাও না কোথাও সে ফাঁকি ধরাও পড়বে। সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভণ্ডামির দিকে আঙুল তুলতে পারলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া যায়। ব্যক্তির শিল্পগুণকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তার প্রেরণা-জাগানো কর্মে যে সুস্পষ্ট নৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, ব্যক্তির নৈতিক চেতনা আর তার কর্ম নীতির একাত্মতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানে কতটা পরিবর্তন এসেছিল বা আসছে, তা কতটা অভিপ্রেত ছিল বা আছে, এগুলো নিয়ে নিজের সাথে নিজের বা আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে জীবন ও কর্ম সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেই চলে।

চেতনায় বিপ্লব -আমরা বাঙালি

সংলাপ ॥ বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘চেতনায় বিপ্লব-আমরা বাঙালি।’

* একজন খাঁটি বাঙালি কখনো মিথ্যা বলে না।

* একজন খাঁটি বাঙালি একজন কুরআনিক মুসলিম।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদের পড়–য়ারা অনেকেই টাকা-পয়সার মোহে সমাজের সর্বস্তরে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিপনার কাজে লিপ্ত রয়েছে – এইসব বিভ্রান্তদের তালিকা তৈরি ও ভালমানুষ করার জন্য সমাজের সবাই এগিয়ে আসি।

* বর্তমানে শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী আর সংস্কৃতির নামে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে। তাই প্রতিটি বাঙালির জীবনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ, লালন ও পালন করি।

* সকল শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্ম গ্রামে। দেশকে সমৃদ্ধ করতে জন্মস্থান গ্রামের সাথে শহর-নগরের ব্যবধান  কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

* ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতদের করা ‘পলিটিক্স’ এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনীতি’ শব্দটির পরিবর্তে দিন বদলের পালায়  ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করি। জননীতি-অর্থাৎ শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগী, সৎ ও মুক্তচিন্তার যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে কাজের সুযোগ করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।

* ‘সত্য বলি, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, নিজে বাঁচি-দেশ ও জাতিকে বাঁচাই।’

* ধৈর্যশীল হয়ে, অন্যের দোষ ক্ষমা করে আল্লাহ্র দরবারে ক্ষমা পাওয়ার প্রার্থী হই।

* কর্ম ও চিন্তায় সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের পরিচয় দিই।

* প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করি এবং আত্মিক উন্নতি করি।

* ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন। তাই কর্ম করি সৃষ্টির সেবাতেই।

* সেই ফুল হই – যে ফুল প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু ঝরে যায় না।