সত্যদর্শী ॥ কোন কিছুর সত্য জানতে হলে
পুরো প্রেক্ষাপটকে ধরেই এগুতে হয়। মহান সাধক আনোয়ারুল হক এঁর অমৃত কথা ‘দর্শন- উপলব্ধিতে
হয় সত্য, অন্যের কথায় নয়’ ।
জগৎ-সংসারে কোন কিছুই অযাচিত নয়, হঠাৎ
ঘটে না। কারণের কারণ থাকে। ঘটনার নেপথ্যে থাকে ঘটনার উপযোগিতা। একটি বোমা বিস্ফোরিত
হলে আমরা শব্দ শুনতে পাই, বোমাটির শক্তি, ক্ষয়-ক্ষতি, বিস্ফোরণের কারণ জানতে পারি।
কিন্তু অনুসন্ধানে ধরা পরে পুরো বিষয়টির সত্য। যা আমাদেরকে নিয়ে যায় সেই সত্যের কাছে,
যে সত্যের নেপথ্যে একটি গোষ্ঠীগত স্বার্থ, সক্ষমতা, চরিত্র লাভ কিংবা সুদূরপ্রসারী
কোন প্রাপ্তি যোগ রয়েছে। আমরা আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, অশান্ত অস্থির মনোভাবের
কারণে কোন কিছুর গভীরে প্রবেশ করতে পারি না বলে হুজুগ, গুজব, বিভ্রান্তি, অতি কাল্পনিক,
গাল গল্পে মশগুল হয়ে পড়ি।
সত্য চোখের সামনে এসে আবার মিলিয়ে যায়।
লালন ফকির ভণিতায় এসে বারবার নিজেকে ভেড়ো স্বভাবের সাথে তুলনা করে প্রকারান্তরে বাঙালি
চরিত্রের গভীর ক্ষত দিকটিই তুলে ধরেছেন।
সম্প্রতি আলজাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত
কারিগরি জারিজুরিটি নিয়েও সেই প্রবণতা দেখা গেল। একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা
যেতে পারে। ভারতবর্ষে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কত মার্কে পাশ নির্ধারিত হবে সেটি নির্ধারণ
করার জন্য ব্রিটিশরা দুঃখজনক একটি ব্যরোমিটারের সাহায্য নিয়েছিলেন। সেটা হলো ব্রিটিশদের
পাশ ছিল ৬৫ মার্কে। বাঙালির মেধা অর্ধেক। ফলে তার অর্ধেক ৩২.৫০ পাশ মার্ক!!! বাংলাদেশ
বহু পথ এগিয়ে গেলেও এখনো বিশ্বের বহু দেশ হেয়ালীর চোখে দেখতে চায়। আর ইসলামের ধব্জাধারী
আরবদের কোন কোন দেশের শাসকরা আমাদেরকে তো মুসলিম হিসেবেই গণ্য করে না।
সত্য ভাসমান পানা নয়। সত্য কোন চমক নয়। সত্য সাইন্স ফিকশন কিংবা কতিপয় লোকের
দক্ষ কারিগরি নয়। কারো মুখের কথায়, জোড়াতালি দিয়ে সত্যের নামে নাটক মুভি বানানো যায়
তাতে সত্য হয়ে যায় না।
এ জন্য ভেড়ো স্বভাবের লোকজন কান নিয়েছে
চিলে শুনেই ছুটতে থাকে। কোনদিন সত্য জানতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন চ্যানেল
আল জাজিরায় প্রচারিত ডকু ড্রামার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর স্বভাব হারানো গুজবধারী লোকের
দৌঁড়ঝাপ নতুন করে সেই পুরোনো কথাটিই মনে করিয়ে দিল। এক শ্রেণীর বাঙালি এখনো কল্পনা
প্রবন, কখনো কখনো আত্মবিস্মৃত। এই সত্য আমাদেরকে মনে রাখতে হবে দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের দেশের স্বাধীনতা কারো দানে পাওয়া নয়। আধিপত্যবাদীদের
মুখে ছাই কালি মেরেই চরম ত্যাগের মহিমামন্ডিত এ দেশের স্বাধীনতা।
পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম এই যুদ্ধে ৩০
লক্ষ মানুষকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। ২ লক্ষ নারী মুক্তি যোদ্ধা এবং ভারতের বিভিন্ন শরনার্থী
ক্যাম্পে অকাল মৃত্যুর স্বীকার ৭/৮ লক্ষ নব জাতকের মৃত্যুকেও যুক্ত করতে হবে স্বাধীনতার
ইতিহাসে।
৭০ এর নির্বাচন যখন স্পষ্টতই স্বাধিকার
স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছিল, তখন ২৮% দেশ বিরোধী লোক স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।
এরাই আবার ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ী চিনিয়ে দিয়েছে, লুটপাট করেছে,
ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ করেছে, পাকিস্তানি সেনাদের রাস্তা ঘাট চিনিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীন দেশে আজও সেই কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা
করেনি। বরং পদে পদে বাধা দিয়েছে। ৭১ সালের পরাজয়ের প্রথম প্রতিশোধ নিয়েছে ৭৫ এর ১৫
অগাষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। লক্ষণীয় বিষয় তথাকথিত আরব বিশ্ব দীর্ঘদিন বাংলাদেশের
স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ তারা এ দেশের কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে মানুষ
কিংবা মুসলিম বলেই মনে করেনি। ৭১ এর যুদ্ধ কেই বরং তারা ইসলাম ভার্সেস বাংলাদেশ হিসেবে
দেখেছে। ধর্মযুদ্ধ হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে ঈমানী আকীদা রক্ষা ও মুসলিম
বিশ্বের ঐক্য প্রশ্নে। ফলে সে সময় মুসলিম দেশগুলোর বহু সংবাদমাধ্যমগুলোও এটিকে পাকিস্তান
ভারত যুদ্ধ হিসেবে বর্ননা করেছে। বর্তমানের আলজাজিরা কিংবা খোদ দেশটির আমির ওমরাহরাও
একই চরিত্র প্রদর্শন করেছে। সেই যে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে আজও বাংলাদেশ
বের হতে পারেনি। ফলে আবারো সেই পুরোনো শকুন খামচে ধরেছে জাতির পতাকা। বিদেশী একটি টেলিভিশন
চ্যানেলকে ব্যবহার করে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের জানান দিলো ঘাতকরা। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টিকে
গুরুত্বহীন মনে করা হলেও কোনভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি
নিবন্ধ করলে প্রচারিত ডকু মুভিটি নির্মানের উদ্দেশ্য ধরা পড়বে।
সম্পুর্ন ডকুফিকশনটিতে নজর দিলে ঘাতকচক্র
ও এদের লক্ষ্য অনুমান করা কঠিন নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম ধ্বংসের পরিস্কার চিত্রটি
যেমন ফুটে উঠে। যাতে করে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হেয় প্রতিপন্ন হয়, সেনা অভ্যন্তরে
বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী হয় এবং শান্তি মিশনে না নেয়া হয় বাংলাদেশ থেকে। তেমনি এক ঢিলে
সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপতি, পুলিশ বিভাগকেও জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ডকুড্রামাটির এমন
একটি বাজে নাম দেয়া হয়েছে, যা বিরাট আঘাত। ইসরায়েল প্রসঙ্গ টেনে এনে মুসলিম বিশ্বে
দেশের ইমেজ নষ্ট করার একটা তৎপরতা, দেশের অভ্যন্তরে
ধর্মীয় উগ্রতাকেও উসকে দেয়ার হীন উদ্দেশ্য ধরা পড়ে।
প্রথমত সেনা প্রধানের নৈতিক ভিত্তিকে যেমন
নাড়াতে চেয়েছে। একই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে একটি দুষ্ট বলয়কে প্রমানের খোঁড়া
সব অজুহাত দাঁড় করাতে চেয়েছে। বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছে বাংলাদেশ একটি মাফিয়া এস্টেট এবং
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব তেমন একটি বলয় দেশে বিদেশে তৎপর। সরকার প্রধানের হাতে সব ক্ষমতা
কুক্ষিগত। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নেই।
পুরো ডকু-ফিকশন কিংবা ফ্লিমটি পর্যবেক্ষণ
করলে বুঝা যায় প্রথমত তারা সেনা প্রধানকে আঘাত করতে চেয়েছে। যেহেতু সেটি করতে হলে রাষ্ট্রের
প্রধান নির্বাহী ব্যক্তিতে জড়াতে হয়। ফলে পুরোনো একটি গল্পের অবতারণা করা হয়েছে মোহাম্মদপুরের
এক সময়ের একটি ঘটনাকে সামনে এনে। অথচ ৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে সন্ত্রাস অস্ত্র সবই আমদানী
করেছে খোদ তৎকালীন শাসকরাই। রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করতে সবই করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান
নিজেই বলেছেন- ‘মানি ইজ নো প্রবলেম/ আমি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করে দেবো’। তখন তো বেঁচে
থাকতেও আত্মগোপন করতে হয়েছে বহুজনকে। আর মহল্লায় টিকে থাকতে প্রতিরোধ করে জীবন হারাতে
হয়েছে অনেককে।
পরিচালক ফিল্মী কায়দায় এনিমেশনের সাহায্যে
প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে একটি ঘটনাকে। অথচ ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন ছিল,
রাজনীতির নামে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা সহ হাজার হাজার আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে
হত্যা করা হয়েছে, সেসবের কোন তথ্য নেই এখানে। নেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ
প্রসঙ্গ। মনে হচ্ছে উড়ে আসা জুড়ে বসেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সাল থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত কি
কি করা হয়েছে, চলেছে তার কোন কথা এখানে নেই। ৯১ সাল থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ভয়াবহ সংখ্যালঘু
উচ্ছেদ নির্যাতনের কোন তথ্য নেই।
বরং আরো একটি গভীর প্রবণতা লক্ষ্য করা
যায়, সেটি হলো ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড যেহেতু কিছু সেনা সদস্য সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল,
সেটির প্রতিশোধ নিতেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী সহ বিজিবিকে কৌশলে ধ্বংস
করছেন!! ভয়াবহ একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি নিয়ে যাচ্ছেন। এমনটাই বলা হয়েছে আল জাজিরা
প্রচারিত এই ডকুফিল্মে। ডকুফিকশনটিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিকে আঘাত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্মিত এই ডকুফিল্মটি রীতিমতো ভয়াবহ কাজ। দেশ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের
প্রতি হুমকি। বিপুল ব্যায়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এটি নির্মান করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক কোন শক্তিশালী মহলের অর্থায়ন ও নিবিড় তদারকিতেই কেবল এমনটি হতে পারে।
প্রচারিত প্রতিবেদনটিতে দেখানো বহু তথ্যই
শেষ পর্যন্ত তেমন কোন কিছুই প্রমান করেনা। যেমন হোটেল কিনতে চাওয়া, ম্যালেয়েশিয়ায় নজরদারি,
একজন মাতালের চাপাবাজি, ড্রোন ব্যবহার করে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, ইসরাইলের সাথে চুক্তি
কিংবা ডিএইচএলে ডকুমেন্টস পাঠানো। তবে এটি প্রমান করে কাজটি বড় পরিকল্পনার অংশ। সরকার
ও দেশপ্রেমিক জনগণের জন্যে কিছু শিক্ষণীয়। আমাদের বুঝতে হবে ষড়যন্ত্রের শেকড় কতটা গভীরে,
ডালপালা কতটা বিস্তৃত।
আমরা হয়তো সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনীতির
নামে লোভের আগুনে পোড়া তথাকথিত বিপ্লবী রাজনীতি,
ফ্রিডম পার্টির দৌরাত্ম্য, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের ময়নাতদন্তই এখনো সম্পন্ন করতে
পারিনি। ১০ ট্রাক অস্ত্র কারা এনেছিল আমরা কি তা জানি আজও ? এক সময় সীমান্তসহ খোদ রাজধানীতে
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আনাগোনার খবর ভুলে গেছি? শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্ডব, একজন যুদ্ধপরাধীকে চাঁদে দেখার গুজবে পিটিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা। মানবতাবিরোধী
দের বিচার বন্ধের নামে তান্ডব, রাজধানীর সড়কে সড়কে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। এসবই
কি একই সূত্রে গাঁথা?
কথায় আছে শকুন যতই উপরে উঠুক চোখ তার ভাগাড়ের
দিকেই থাকে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি ’৭১, ৫২’র চেতনা। চেতনা হয়তো কফিন বন্দি। আবার সক্রিয়
সেই একই ঘাতকেরা। এখন ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে। যেহেতু এদের বিদেশী বন্ধু রয়েছে। দেশে আছে
ইন্টারেস্ট গ্রুপ। এসব গ্রুপের রয়েছে পাহাড় সমান টাকা। সেসব টাকায় পোষা পাহারাদার।
মুখোশ পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরে মহল্লায় অফিসপাড়ায়।
ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো পথ হারিয়ে
ফেলেছে। সীমাহীন ভ্রান্ত রাজনীতি সহজ করে তুলেছে ঘাতকদের কাজকে। তথাকথিত উন্নয়নের রাজনীতির
চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশ। গালগল্প তোষামোদের রাজনীতি। ফলে কর্ম ফল হয়ে দেখা
দিচ্ছে। জিডিপির হিসাব আছে কালচারাল জিডিপির হিসাব কারো জানা নেই। বরং চরিত্রহীনদের
মোকাবেলা করতে যেয়ে শাসকদলও সেই স্রোতে কম বেশি ভেসে চলেছে। পর্যবেক্ষণ বলছে গভীর ঘুমে
আচ্ছন্ন সরকারী দলের প্রায় সব পর্যায়ের নেতা কর্মী। কেবলই উদভ্রান্তের মতো দৌঁড়ঝাপ।
স্বজন প্রীতি, পকেট নীতি, দালাল তৈরীই যেন রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে
যেমন অরক্ষিত করে তুলেছিল নিজেরাই। তেমনি বর্তমান নেতৃত্ব শেখ হাসিনাকেই বিপদাপন্ন
করে তুলছেন। মুজিব বর্ষ উদযাপনের নামেও অপ্রয়োজনীয় অদরকারী লোকদেখানো কর্মকান্ডের মহড়া
চলছে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে। পদে পদে বর্নচোরা মুনাফেকরা ফাঁদ পেতেছে।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজজামান বলেছিলেন
– ‘আওয়ামীলীগ আমাদের সমর্থন চায়, পরামর্শ চায় না’। তবু বলবো উন্নয়নের রাজনীতি নয়, দরকার
রাজনীতির উন্নয়ন। একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক জাগরণ। যা উপেক্ষা করা হয়েছে। নতুন ভাবনার
রাজনীতি নেই। রাজনীতিতে সৃষ্টিশীল ভাবনা অনুপস্থিত। জাতি চেতনার শক্তির উপর দাঁড়িয়েই
হাসতে হয় বিজয়ের হাসি। যা বেমালুম ভুলে বসে আছে রাজনীতিকরা।
ড. খাঁন সরফরাজ আলী ॥ বাঙালি জাতির আত্ম-পরিচয়,
স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের মূলে যে মহান দিনটির অবদান রয়েছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের মহান
শহীদ দিবস ও ভাষা দিবস। নিজস্ব ভাষার অধিকার আদায়ে পৃথিবীর অন্যতম দেশ বাংলাদেশের একজন
গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমরা ভাগ্যবান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ
ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের ভাষার অধিকারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়াসে
জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান প্রকারান্তরে বাংলা
ভাষাভাষী এদেশের জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শামিল।
একজন পেশাজীবি হিসেবে পরিচয় যাই হোক না
কেন সর্বপ্রথম আমি বাঙালি। বাংলা মায়ের সন্তান। বাংলা ভাষাভাষী ও একজন বাংলাদেশী হিসেবে
আমি গর্বিত। ৫২’র ভাষা আন্দোলন স্বচক্ষে দেখার সুযোগ না হলেও বাল্যকাল হতেই একুশের
প্রথম প্রহরে প্রভাত ফেরীতে অংশ নেয়া ও শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের অভিজ্ঞতা
হয়েছে। দেশপ্রেম ও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পনের বোধ আসে মূলতঃ স্কুল জীবনে।
আশির দশকের শেষে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত
অবস্থায় মহান শহীদ দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে কতিপয় স্কুল পড়–য়া কিশোর একতাবদ্ধ হয়ে সরকারি
বাসভবনের নিজস্ব খেলার মাঠে ইট, বালু ও চুনের গুড়া দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা রাত
হতে শহীদ মিনারের আদলে বেদী বানানোর আনন্দে মেতে উঠতাম। একইসঙ্গে, পার্শবর্তী বিভিন্ন
বাগান হতে ফুল সংগ্রহ করে নিজেরাই শ্রদ্ধার্ঘ্য বানিয়ে নিতাম। পাশাপাশি, টিফিনের খরচ
হতে বাঁচানো টাকা-পয়সা জড় করে মাইক ভাড়া করে।
সন্ধ্যা রাত হতেই বাজানো শুরু করতাম ‘আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। সমবয়সী কিশোর-তরুণ ছাড়াও
এলাকার সব শ্রেণী-পেশার লোকজন ধর্ম, বর্ণ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে আমাদের এ আয়োজনে
সক্রিয় অংশ নিতেন। কালো রংয়ের কাপড় কেটে নিজেরাই ছোট ছোট ব্যাজ বানিয়ে পরিধেয় পোষাকের
সঙ্গে লাগিয়ে শোক প্রকাশ করতাম। এ আয়োজন চলতো ২১’এর দুপুর পর্যন্ত। অনেকটা একই ধাঁচের
আয়োজন করা হতো বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ
নিয়েছি। নতুন প্রজন্ম এ অভিজ্ঞতার স্বাদ পাবে কিনা জানিনা তবে আমরা যারা প্রত্যক্ষ
করেছি তারা তা ভুলতে পারবো না।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীসহ যাওয়ার
অভিজ্ঞতা হয় মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়। সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থাতেই
স্বীয় বিভাগ ও হলের সিনিয়র ও সহপাঠীদের সঙ্গে খালি পায়ে একযোগে কালো ব্যানার হাতে ছোট
ছোট ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিয়ে শহীদ মিনারের বেদীতে ভাষা শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন
করেছি আর সেখান থেকে সোজা ছুটে গিয়েছি একুশের বই মেলায়। সাদা পাঞ্জাবি আর কালো প্যান্ট
ছিল আমাদের সে সময়ের পোষাকী ঢং। পরের বছরগুলোতেও এ ধারাবাহিকতার কোন ব্যত্যয় হয়নি।
বরং সম্মান শেষ বর্ষে ও মাস্টার্স-এ অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রথম সারিতে থেকে এ ধরনের আয়োজনে
নেতৃত্ব দিয়েছি। ফলশ্রুতিতে, দেশপ্রেম ও ভাষা শহীদদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার অংশ হিসেবে
যে কোন অবস্থাতে শহীদ মিনারে গিয়ে একুশের আয়োজনে অংশ নেয়া একটি রীতি হয়ে গিয়েছিল।
ছাত্র জীবন শেষ করে চাকুরির শুরুতে রাজধানীর
একটি প্রতিষ্ঠিত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে ২০০১ সালে প্রথম বারের মত ছাত্র-ছাত্রী,
শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যানার হাতে প্রভাত ফেরী নিয়ে কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এখনো শিহরণ জাগায়। পরবর্র্তীতে যখন জানতে পারলাম আমাদের
বেদীতে ফুল নিবেদনের পর্বটি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের
চেয়ে নিজেই বেশী পুলক অনুভব করেছি। অন্ততঃ এই ভেবে যে, পরবর্তী প্রজন্ম একুশ ও ভাষা
শহীদদের সম্বন্ধে জানতে পারছে আর তাতে অংশ নিচ্ছে। এখন ভাবতেই অবাক হই যে, সেদিন রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত
শহরে যানবাহন ও গণমানুষের ভীড় ঠেলে সাইন্স ল্যাবরেটরির মোড় হতে নীলক্ষেত পার হয়ে বুয়েটের
ভিতর দিয়ে ক্লান্তিহীন পায়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই একযোগে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি।
একমুখী পথ চলাচলের কারণে শহীদ মিনার হতে বেরিয়ে বাংলা একাডেমীর বইমেলা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিতর দিয়ে শাহবাগ মোড় হয়ে বেরিয়ে এসেছি।
সময়ের পরিসরে ও বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
প্রভাত ফেরী ও একুশের প্রহরে শহীদ মিনারে যাওয়ার রীতি ধীরেধীরে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত
হলেও প্রকৃত বাঙালি মনে একুশ মানে বাংলাকে চেনা, বাংলাকে জানা আর বারবার বাংলাকে ফিরে
পাওয়া। আর তাই একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে সর্বস্তরে বাংলার চর্চা ও শুদ্ধ বাংলার অনুশীলন
আন্দোলনে সোচ্চার হওয়া এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। এ প্রেক্ষিতে যার
যার অবস্থান থেকে সকল স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে সত্যিকারের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের প্রতি
আন্তরিক হয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারলে তবেই দেশ এগিয়ে যাবে এবং জাতি হিসেবে
আমরা পৃথিবীর বুকে সম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হবো।
হাসান জামান টিপু ॥ ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন
কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনে All the prime minister’s সবহ নামে যে অনুসন্ধানী
প্রতিবেদনের প্রথমপর্ব প্রচারিত হলো তাতে বাংলাদেশের জনমত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবনে ও প্রতিক্রিয়া দেখাতে। জনগণের
যে অংশটি সরকারবিরোধী তারা উল্লাসিত এই জন্য যে প্রতিবেদনটিতে সরকারের মধ্যে যে মাফিয়া
তন্ত্রের প্রভাব এতো গভীর তাতে তারা জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার উল্লাসিত এবং ভবিষ্যতে
সরকার পতনের একটা ভিত্তি তৈরি হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তারা আরও উল্লাসিত কারণ জানা
গেছে এরকম আরো পর্ব ধারাবাহিকভাবে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের গোপনীয় ও স্পর্শকাতর কিছু
বিষয় একটা বিদেশী টিভি ক্যামেরা ধারণ করে নিলো যা সচেতন মানুষকে ভাবাচ্ছে।
All the prime minister’s সবহ এ কি কি
আছে ?
১. সেনা প্রধানের পরিবারের লোকজন মাফিয়া,
খুনি ও সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার অভিযোগ।
২. বিডিআর প্রধান থাকাকালে সরকারকে ভোটে
জয় ও সেনা প্রধান হিসাবে সরকারকে পূর্ণ অনৈতিক সহায়তা করা।
৩. হাঙ্গেরির মাধ্যমে ইসরাইলি স্পাইওয়্যার
নামক অত্যাধুনিক গোয়েন্দা
সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া।
৪. সেনা প্রধানের ভাই মন্ত্রী, এমপি ও
সরকারের নানান মহলে ঘুষ দিয়ে বা ভাগ বাটোয়ারার মাধ্যমে টেন্ডার পাইয়ে এবং তারা ২০%
হারে কমিশন নিয়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ।
৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহৃত
হয়।
৬. বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলি সেনা
প্রধান আজিজ সাহেবের ভাইকে সহযোগিতা করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডকুমেন্টারিটি উন্নত
প্রযুক্তির ব্যবহারে তৈরি এবং উন্নতমানের নির্মাণ। প্রাথমিক একটা উত্তেজনা তৈরি করতে
এটি সুড়সুড়ি দেয় বটে তবে দীর্ঘস্থায়ী কোন প্রতিক্রিয়া তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এই
প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু সেনাবাহিনী, বিডিআর, র্যাব ও পুলিশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা
একটা একপেশে প্রোপাগান্ডার অংশ, যথেষ্ট যুক্তিনির্ভর নয়। দেশে একাধিকবার বিভিন্ন অপকর্মের
বা অপরাধের দায়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক, পরে বিদেশে পলাতক একজন বিদেশে বসে বললো,
আর তা সত্য হিসাবে প্রচার করা যথেষ্ট তথ্যপূর্ণ না হলে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হওয়াটাই
স্বাভাবিক।
সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
নিয়ে এমন প্রতিবেদন করার আগে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিলো। দেশী বিদেশী যে
কোন সাংবাদিকের জন্য এটা আবশ্যক। নিরপেক্ষতা ও নির্মোহতা সাংবাদিকতার অন্যতম হাতিয়ার
অন্যথায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, নিছক প্রোপাগান্ডা হিসেবে গণ্য হয়। এতে
সংবাদের উৎসগুলি যথেষ্ট নির্ভরশীল নয়। তাদের অন্যতম সোর্স সামি একজন মধ্যস্থতাকারী
হিসাবে কাজ করে তার মানে দালাল নিজেও একজন অপরাধী। এই দালালের সাথে হারিসের আলাপচারিতায়
বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে। যা রাজা উজির মারার মতো বাগাম্ভরপূর্ণ যা প্রায়শ একজন স্বল্প-শিক্ষিত
মাত্রাজ্ঞানহীন মানুষ করে থাকে। সামির দেওয়া তথ্য কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় যতক্ষণ না সেগুলি
যথেষ্ট তথ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন অনেক দৃঢ়, মানুষজনও বেশী
ক্ষমতায় থাকা লোকগুলিকে বেশী মাত্রায় তোয়াজ করে এগুলো এদেশের সংস্কৃতির একটা অংশ। এতে
যদি আইনে ব্যত্যয় না ঘটে তবে তা আলোচ্য হতে পারে না।
কমিশনে বা দালালদের মাধ্যমে এদেশে কেন
সারা বিশ্বেই ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে থাকে সেখানে ২০% একটা অবাস্তব অংক। এরকম কমিশন দিয়ে
কেউই ব্যবসা করবে না। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ভেদে এটা ১-৩% হতে পারে। কেউ একজন
ব্যবসা পেতে সাহায্য করলে পারিশ্রমিক হিসাবে টাকা পেতেই পারে। সামরিক সরঞ্জাম যদি ইসরায়েল
থেকে তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে এসে থাকে এটা এই প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়নি।
আলজাজিরা বাংলাদেশকে নিয়ে বিশেষ করে বাংলাদেশ
সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের উল্টো দিকে চলা একটা সংবাদ মাধ্যম। এরা এর আগে হেফাজত নিয়ে
যে রিপোর্ট করেছিলো তা মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে হয়েছিলো যা প্রমাণিত। যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের সময়ও আল জাজিরার ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো যা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বিরোধী।
সেনাপ্রধানের নিয়োগ রাজনৈতিকভাবে হয়, তিনি
প্রধানমন্ত্রীর লোক হবেন সেটাও স্বাভাবিক আর তিনি যে তার আতœীয় স্বজনের অপরাধের
দায় নেবেন তাও নয়। তার ভাইদের তিনি যদি সাহায্য করেও থাকেন এবং তা যদি আইনভঙ্গের কারণ
না হয় তবে সমস্যা কোথায়? আল জাজিরা যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলে বাংলাদেশের পজিটিভ খবরগুলিও
প্রচার করতো যা তারা কখনোই করে না। তাই সংবাদমাধ্যম হিসেবে তারা যে বিশ্বাসযোগ্যতা
সে দাবী করতে পারে না। এতে ধারণা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে এই ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছে চটকদার
মাল মসলায়। তাঁরা যে তাদের ফুটেজে অনেক কাট পেস্ট করেছে, তাও প্রমাণিত হয়ে গেছে। এতেও
রিপোর্ট গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। যা সাংবাদিকতা কিংবা ডকুমেন্টারি তৈরির নীতিমালার চরম ব্যত্যয়।
তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ যে নিজে ‘তলাবিহীন
ঝুড়ি’ থেকে একটা অবস্থানে পৌঁছেছে তা একটা সিনেমাটিক সাফল্যের গল্প শুধু নয়, এখানে
অনেক ধরণের আপোষ ও চাতুর্যময় সিদ্ধান্তের ব্যাপার থাকে, থাকে অনেককিছুই উপেক্ষা করার
যার মধ্য দিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া
যায়।
সে প্রচেষ্টার রাস্তা কখনোই সরলরৈখিক নয়, মসৃণ নয়। সংবাদমাধ্যমকে সেই পরিক্রমাটা
নির্মোহভাবে তুলে ধরতে হয় তা না হলে সংবাদ মাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। স্মরণ রাখতে
হবে এটা নাগরিক সাংবাদিকতার যুগ, এখানে তথ্য লুকানো বা ম্যানুপুলেট করা খুব কঠিন।
নজরুল ইশতিয়াক ॥ ভক্তের ভালবাসা, প্রেম,
পূজা পেতেই গুরুর আসা, আবির্ভাব। ভক্তের দ্বারে বাধা আছেন সাঁই। সাধক কাজী নজরুল ইসলাম
বলেছেন -‘কৃষ্ণ তো রাধাময় দেহ’। এমন শত সহস্র উপাধি দেয়া যায় গুরু এবং শিষ্যের সম্পর্ক
নিয়ে। সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ বললেন- ‘গুরু যোগ্য ভক্তের চক্ষু, কর্ণে, জিহবায় এসে
বসেন। ভক্ত কে দর্শন করেন। ভক্তকে দর্শন করে চলে যান। সম্পর্ক হলে আর কিছু লাগে না’।
তিনি আরো বললেন- ‘যোগ্য ভক্তের সাথে গুরুর এই চোখাচোখি, অনুরাগ কোনদিন কোন কালে শেষ
হয়না। ইন অল আসপেক্ট-এ ভক্ত গুরুকে পান’।
সম্পর্ক নামক শব্দটি দিয়ে সম্পর্ক বুঝা
যায় না। সম ভাব, সম ক্ষেপণ, সম চিন্তন, স্পন্দন, মানকেই নির্দেশ করে। এতে গুরুর গুরুত্ব
কমে যায় না। প্রকৃত ভক্ত জানেন গুরু সব সময় গুরুই। তবু সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ বললেন-
গুরু যোগ্য ভক্তকে এগিয়ে দিয়ে আনন্দ পান। সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ একটি সফরের কথা
উল্লেখ করে বললেন- ‘লম্বা সফর, আমি ড্রাইভ করছিলাম আর সূফী সাধক আনোয়ারুল হক পাশের
সীটে। নানান আলাপ চারিতা। আমরা তখন রাম-লক্ষণ দুই ভাই।’ সাধনার জগতে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক কোন নিক্তি, কোন
ভিত্তি, কখন কোন রঙে, রূপে রূপলাভ করে, করতে পারে মহান সাধকের এই একটি কথার মধ্যে দিয়ে
কিছুটা হলে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয় আমাদেরকে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – মাঝে মাঝে তব দেখ
পাই, চিরদিন কেন পায় না’। এই কথাটি এখানে খাটে না। প্রকৃত ভক্ত সব সময় গুরুর আলোয় থাকেন।
লালন ফকির বললেন- গুরু শিষ্যের এমনি ধারা চাঁদের কোলে থাকে তারা/ চাঁদের গায়ে চাঁদ
আছে ঢাকা/ চাঁদ হতে হয় চাঁদের সৃষ্টি।’ জন্ম এবং সৃষ্টির মধ্যে যে বিশাল বিরাট পার্থক্য।
সীমাহীন দূরত্ব, তা তো সাধক সান্নিধ্যে এসে জানা গেল। সাধনপীঠে এই মানুষই সৃজনশীল মানুষ
হয়ে উঠেন। নব অনুরাগে নব জন্ম। এটিকেই সৃষ্টি বলা হচ্ছে। যিনি সৃষ্টি কর্মটি করছেন
ভক্তের কাছে তিনিই স্রষ্টা।
সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ বললেন- ‘প্রতিটি
পরিবর্তনেই প্রাপ্তির সৌন্দর্য। হাক্কানী থট কে এগিয়ে নিতেই কাজ করা হচ্ছে। এখানে পীর
মুরিদ সিষ্টেম নেই।’
মহান সাধক বললেন- যে যা নিয়ে এসেছে তাই
ফেরত পাবে। মহান সাধকের এই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ
দিকনির্দেশনাটি উপলব্ধি করতে হবে। তিনি গভীর একটি উপলব্ধির দ্বার উন্মোচন করে
দিয়েছেন।
তিনি অনত্র বললেন – দরবার উন্মুক্ত, যতটুকু
করবেন ততটুকুই পাবেন। ভক্ত তার চারপাশে যেখানে যতদূর দেখবেন সবই গুরু গুরুময়। গুরুর
জগতই দেখতে পান। নিজেকে আবিস্কার করেন গুরু সাগরে। ধৈর্য নামক অলংকার পরে, গুরু রঙে
রঞ্জিত হয়ে উঠেন। সেখানেই অহংকার হলো আত্মমর্যাদা। মর্যাদা একটি বোধ।
সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ বললেন- আমিত্ব
থাকবেই। আমিত্ব থাকা দোষের নয়, লক্ষ্যের ব্যাপারে একরৈখিক কিনা এটিই দেখার বিষয়।
সংলাপ ॥ মানুষ জন্মাবার পর পারিপার্শ্বিকতা
হতে তার অভ্যাসের মাধ্যমে স্বভাব গড়ে তোলে। প্রথমে সে চোখকে বেশি কাজে লাগায়। অনুকরণ
ও অনুসরণ করতে চেষ্টা করে পরিবারের সদস্যদের এবং চোখ দিয়ে যা দেখছে সেগুলোকে। অতঃপর
চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকের সহযোগিতায় হাত, পা, মুখ, পায়খানা ও প্রসাবের রাস্তা
সমূহের দ্বারা বিভিন্ন কর্মের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। যখনই কোন কর্ম করে তখনই সে
সুখ, দুঃখ বা ঔদাসীন্যের সঙ্গে জড়িত হয়, কর্মফলের উপর নির্ভর করে। এভাবেই ধীরে ধীরে
সে বড় হতে থাকে পরিবেশগত কর্মের মাধ্যমে। গবেষকদের মতে একজন পূর্নাঙ্গ মানুষ ৭ (সাত)
হাজার হতে ৮ (আট) হাজার কর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে প্রতিদিন। প্রতিদিনের এই কর্মগুলোর
মধ্য দিয়েই একই পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত কর্মের বারবার বাস্তবায়নে তার গড়ে ওঠে অভ্যাস। এই
অভ্যাসের বার বার প্রকাশ ভঙ্গিকেই আমরা স্বভাব বলে থাকি। ধর্মীয় আঙ্গিকে স্বভাবের উপর
বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্বভাবের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সর্বযুগে-সর্বকালে
সকল ধর্মে।
ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে সরাসরি স্বভাবের উপর
জোর দেয়া হয়েছে আত্মিক উন্নতির জন্য। নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত) বলেছেন
: সৎ-স্বভাবই ধর্ম।
ধর্মীয় গবেষকগণ স্বভাবের পরিচয় বা তত্ত্ব
বিশ্লেষণে নানা মতের জন্ম দিয়েছেন নিজেদের জানা ও উপলব্ধিবোধ হতে। যেমন – হাসি মুখ,
কষ্ট সহ্য করা বা অত্যাচারে প্রতিশোধ না নেয়া। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলো এক একটি
শাখা বা লক্ষণ কিন্তু স্বভাবের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নয়।
মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্ম নেয়। পরবর্তীতে
নিজের এক এক রূপ সৃষ্টি করে বিবর্তনের ধারায়। পরিবেশকে মোকাবিলা করার জন্যে কর্ম করে।
কর্মের মধ্য দিয়েই তার চিন্তাজগত ব্যস্ত থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের
প্রকৃতি ও বৃত্তিগুলো সমভাবেই বিকশিত ও স্ফূর্ত হয়। এই বিকাশের ধারা থেকেই জানার আগ্রহ,
বুদ্ধিমত্তা, দমন শক্তি, প্রবৃত্তিগুলো জেগে উঠে। এদের মাঝে সমতা এবং সামঞ্জস্য রক্ষা
করার জন্য উদ্ভব ঘটে বিচার শক্তির। এই শক্তির কম স্বভাব অপূর্ণ থাকে। কম হলে দুর্বল
বা অকর্মণ্য হয় আর বেশি হলে কুৎসিত আকার ধারণ করে এবং তা তার কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত
হয়। একই তালে শক্তির প্রবৃদ্ধি যখন ঘটে একটা কর্মকে কেন্দ্র করে তখনই গড়ে ওঠে স্বভাব।
স্বভাব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এবং তা যথাক্রমে সৎ-স্বভাব
ও অসৎ স্বভাব। এই দুই স্বভাবের মধ্যে ব্যবধান নির্ণয় করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা
নেই। ব্যক্তি যখন তাকে সজাগ রাখে তার বিচার শক্তি দিয়ে এবং প্রতিটি কর্ম বিশ্লেষণ করে
চৈতন্যশীল হয় তখনই তার মধ্যে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয় আর এই দ্বন্দ্বই তাকে তার মতো করে
সৎ-অসৎ পথের সন্ধান দেয়।
যখনই দ্বন্দ্ব দেখা দেয় প্রতিটি কর্মকে
ঘিরে তখনই উচ্চস্তরের ব্যক্তিত্বের সংসর্গে আসা একান্ত আবশ্যক যিনি আত্মসংশোধনের বীজ
বপন করতে পারেন তার মধ্যে। তিনি উন্নতির পথগুলো ব্যাখ্যা করবেন এবং পারিপার্শ্বিকতা
গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবেন। এছাড়াও যখন কেহ কর্ম বিশ্লেষণ করে নিজে উপলব্ধি করে তার
কর্মগুলো খারাপ তখন তাকে ঠিক উল্টো কর্মগুলো করতে হবে যাতে সে নিজেকে দমন করতে পারে
এবং সঠিক পথে চলতে পারে। কাজের অভ্যাস করতে থাকলে পরিশেষে এই অভ্যাসই তার স্বভাব হয়ে
দাঁড়ায়। আর এই কারণেই বলা হয় অভ্যাস থেকেই স্বভাব। এখানেই অনুসন্ধিৎসু মানুষ পথ প্রদর্শক
খোঁজে এবং গুরুর সন্ধান করে আত্মিক উন্নতির
জন্যে। গুরু তাকে পথ দেখায় – স্বভাব গড়ার জন্য।
দেহকে কার্যকরী করে যে সমস্ত কাজ করা যায়
তার একটা প্রভাব অভ্যন্তরীণ চিন্তাজগতের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। ফলে ব্যক্তি এক অনির্বচনীয়
জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। গুরুর নির্দেশ আনন্দের সাথে পালন করে চলে। না পারার পথ
ধরে নিষ্ঠা সহকারে পালন করা প্রয়োজন।
সাধনা এবং পরিশ্রম দুটোর সাহায্যেই স্বভাব
ও গুণ অর্জন করা যায় এবং আধ্যাত্মিক জগতই মানবজাতির মূল উৎপত্তিস্থল। ধন-দৌলত এবং পার্থিব
প্রতিপত্তির মোহে মত্ত থাকলে পার্থিব স্বভাব গড়ে উঠে। বুদ্ধিমান সেই যে নিজের দোষ-ত্রুটি
সম্বন্ধে সজাগ থাকে।
এই আলোকে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক
ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বভাবের কি প্রয়োজন তা একটু চিন্তা করলে বেশ বুঝা যাবে। প্রত্যেকটি
পরিবার সচেতন হলে সমাজ সচেতন হবে এবং সামাজিক পরিবর্তনের পথ খুলে যাবে।
অপরদিকে রাষ্ট্রীয় জীবনে যে দলই ক্ষমতায়
আসুক না কেন কর্ণধারদের অবশ্যই আদর্শিক স্বভাবী হতে হবে। তাঁদের আদর্শিক স্বভাব থাকলে
তারই স্পর্শে প্রশাসনিক ধারায় সত্যের প্রভাব পড়তে থাকবে যা শুধু সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ
করবে না বরং অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে।
পৃথিবীর সকল চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় কিন্তু
নিজের বিবেককে ফাঁকি দেয়া যায় না। তাই মানুষ সংসার জীবনে শুধু লোভ আর মিথ্যা অহংকারের
বশবর্তী হয়ে বিবেকের তাড়নাকে ঢাকা দেয়ার জন্য অভিনয় করে যাচ্ছে মাত্র। ব্যক্তিজীবনে
প্রত্যেক মানুষই ধর্মপালন করে যাচ্ছে আর সেটা হচ্ছে তার ইচ্ছামতো ইচ্ছাধর্ম। তাতে তার
লোভ ও অহংকার দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। ‘সংযম’ বলে শব্দটা বই পুস্তকে রয়ে যাচ্ছে কিন্তু
ব্যক্তিজীবনে এর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।
সংযমকে স্ব-স্ব জীবনে বাস্তবায়িত করার
জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে চোখ। এই চোখই যতো নষ্টের গোড়া আবার এই চোখই সাধারণ মানুষকে
আত্মিক উন্নতিতে প্রধান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটায়। এই প্রক্রিয়ায়
ব্যক্তির অভ্যাসের পরিবর্তন দলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে করতে সমগ্র জাতির স্ব-ভাব
গড়ে প্রভাব বিস্তার করে জাতীয় জীবনে, এক মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তাই প্রয়োজন
নেতৃত্বদানকারী নেতা-নেত্রীর অভ্যাসের পরিবর্তন। বিপদে পড়লে মানুষের চরিত্রের অনেক
দিক উন্মোচিত হয় আবার প্রকৃত বন্ধুও চেনা যায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে দেশবাসী না খেয়ে
থাকতে পারে কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তারা একটু শান্তি চায়, একটা সুন্দর পরিবেশ চায় যেখানে
সার্বিক আতঙ্কমুক্ত থাকতে পারা যায়। আসুন না, আমরা একবার নিজের অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করে স্ব-ভাবে স্বভাবী হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের পথে পা রাখি।
সংলাপ ॥ সূফী সাধক খাজা মঈন উদ্দিন হাসান
চিশতি এঁর জন্ম সিস্তানের চিশতি নামক গ্রামে। তাঁর জন্মসাল নিয়ে মতবিরোধ আছে। মতবিরোধের সীমানা
হিজরি ৫৩০ থেকে ৫৩৭। তা সত্ত্বেও ৫৩৬ হিজরির (১১৪১ খ্রি.) ১৪ রজবকে জন্ম সন ও তারিখ
হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে মোটামুটি একটা ঐক্যমত আছে। পিতা-মাতা উভয়ের দিক থেকেই তিনি
হযরত আলীর বংশধর। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং সাধক, নাম- গিয়াসুদ্দীন হাসান।
তাঁর মায়ের নাম, সাইয়েদা উম্মুল ওয়ারা।
তাঁর আবির্ভাবকালে সমগ্র মুসলিম জগতেই
ছিল অরাজকতা ও নৈরাজ্য। বিশেষ করে তাঁর জন্মস্থান সিস্তানে মানব জীবনের কোন নিরাপত্তা
ছিল না। মারামারি, কাটাকাটি, লুটতরাজ, রাহাজানী লেগেই থাকতো। তাছাড়াও তাতার জাতির অত্যাচারে
অতিষ্ট ছিল সাধারণ মানুষ। এরকম পরিস্থিতিতে তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দীন হাসান নিরাপত্তার
খোঁজে সিস্তান ছেড়ে রাজধানী নিশাপুরে বসবাস শুরু করেন। নিশাপুর ছিল তৎকালীন সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের
কেন্দ্র। নিশাপুরের নিজামিয়া পাঠাগার ছিল বিশ্বখ্যাত। কিন্তু যে শান্তি ও নিরাপত্তার
সন্ধানে পিতা গিয়াসুদ্দিন হাসান সিস্তান ছেড়ে এসেছিলেন তা নিশাপুরেও ছিল না। সুলতান
একদিকে তার ভাইদের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন অন্যদিকে, তাকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ
প্রতিহত করতে হতো। এক পর্যায়ে বহিঃশত্রুদের সাথে যুদ্ধে সুলতানের পতন হলে শত্রুরা রাজ্যে
প্রবেশ করে অসংখ্য নিরীহ জনতাকে বিশেষ করে জ্ঞানী-গুণীদের হত্যা করে, নারী ও তরুণদের
বলপ্রয়োগে তাদের দাসত্ব করতে বাধ্য করে।
খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি শিশুকাল থেকেই
তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া শুরু করেন। তাঁর পিতা একজন প্রখ্যাত আলেম ও আরেফ ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি শরীয়ত ও মারেফাত বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। কথিত আছে, মাত্র ১০ বৎসর
বয়সে তিনি কুরআনে হাফেজ হয়েছিলেন।
হিজরী ৫৫১ সালে ১৫ বৎসর বয়সে খাজা মঈন
উদ্দিন হাসান চিশতি পিতৃহারা হন। মা হারিয়েছিলেন এর আগেই। ফলে লোভ, হিংস্রতা, হত্যা
ও রাহাজানির মধ্যে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তিনি একবারেই একা হয়ে যান।
তরুণ খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি – এঁর
মানসে দেশব্যাপী হত্যা, লুণ্ঠন এবং নৈরাজ্যকর পরিবেশ গভীর দাগ কাটে। শিশুকাল থেকেই
তিনি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন তাও তাঁর মনে গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরকম ভয়ংকর
পঙ্কিল পরিস্থিতি থেকে তিনি মুক্তির পথ খোঁজেন, ভাবতে থাকেন পরিত্রাণের পথ, নিবিষ্ট
হলেন প্রকৃত শান্তির অন্বেষায়। তাঁর দরদী মন নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ
হয়ে উঠে। ঐ সময় থেকেই তিনি অসহায় মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। যৌবনের সমগ্র
শক্তি ও সাহস তিনি ব্যয় করেছেন আধ্যাত্মিক সাধনায়। যৌবনে তিনি বিয়ে করেননি। লক্ষ্য
অর্জনের পর, মতান্তরে ৫৯০ হিজরিতে তিনি প্রথম বিয়ে করেন। তিনি নিজে তাঁর স্ত্রীকে স্ব-ধর্মে
দিক্ষীত করেন এবং স্ত্রীর নাম রাখেন বিবি আমাতুল্লাহ।
৬২০ হিজরীতে অর্থাৎ প্রায় ৯০ বৎসর বয়সে
তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বিবি আসমত। বিবি আসমত ছিলেন আজমীরের
কমিশনার সৈয়দ ওয়াজিউদ্দিনের কন্যা। সৈয়দ ওয়াজিউদ্দিন তার কন্যার বিয়ের জন্য উদ্বিগ্ন
ছিলেন। কথিত আছে, তিনি একদিন স্বপ্নে রসুল সা. হতে তার মেয়েকে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি-এঁর
নিকট বিয়ে দেবার জন্য নির্দেশিত হন। খাজা ছিলেন আঁতায়ে রসুল অর্থাৎ রসুল সা. এঁর উপহার।
তাই তিনি ওয়াজউদ্দিনের প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
দুনিয়াদারির হিসেবে খাজা মঈন উদ্দিন হাসান
চিশতি -এঁর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে ছিল। তিন ছেলের নাম – ফখরুদ্দিন, হিসামুদ্দিন, জিয়াদ্দিন।
মেয়ের নাম- বিবি হাফিজা জামাল। মতান্তরে জিয়াদ্দিনের মা ছিলেন বিবি আসমত। বড় ছেলে ফখরুদ্দিন
আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন এবং দিল্লীর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সংস্পর্শে আসেন।
১২৬৫ খৃষ্টাব্দে তিনি দেহত্যাগ করেন। আজমীর থেকে ৩৭ মাইল দূরে আজমীর কিকরি রোডে তাকে
শায়িত করা হয়। দ্বিতীয় ছেলে হিসামুদ্দিনও সাধক ছিলেন। তিনি ১২৫৫ সালে দেহত্যাগ করেন।
তৃতীয় সন্তান জিয়াদ্দিন সম্পর্কে এইটুকুই জানা যায় যে, ৫০ বৎসর বয়সে তিনি দেহত্যাগ
করেন। আজমীরে দরগায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়। দুনিয়াদারির হিসেবে তাঁর একমাত্র মেয়ে, বিবি
হাফিজা জামাল ছিলেন বিদূষী মহিলা। তার বিয়ে হয়েছিলো সূফী সাধক হামিদ উদ্দিনের ছেলে
রাজিউদ্দিনের সাথে। দরগার দক্ষিণ দিকে বিবি হাফিজা জামাল শায়িত আছেন। খাজার সহধর্মীনীদেরকেও
আজমীর দরগায় সমাধিস্থ করা হয়।
হিজরি ৬৩৩ সনে (১২৩৩ খ্রি.) ৬ রজবে ৯৭
বৎসর বয়সে খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি দেহত্যাগ করেন। ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং আধ্যাত্মিক
আবেগ ও অনুভূতির মহাকর্ষণে প্রতি বছর ৬ রজবে তাঁর উরস বা মহামিলন দিবস উৎযাপন করা হয়।
সংক্ষেপে এই তাঁর দুনিয়াদারি জীবন।
কিন্তু তাঁর প্রকৃত জীবন হচ্ছে সাধনার
জীবন, দর্শন এবং দরশনের জীবন। যতদূর জানা যায়, এ জীবনের শুরু হিজরি ৫৫৬ সনে অর্থাৎ
২০ বৎসর বয়সে, একটি বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে। ঘটনাটা হলো- হিজরি ৫৫৬ সনে খাজা মঈন উদ্দিন
হাসান চিশতি একদিন তাঁর বাগানে পানি দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মজ্জুম সাধক তাঁর দিকে এগিয়ে
এলেন। তিনির মজ্জুম সাধকের হাতে চুমু খেয়ে তাঁকে গাছের ছায়ায় বসতে আকুতি জানালেন। বাগান
থেকে কিছু আঙ্গুর নিয়ে এলেন তাঁর জন্য। সাধক, তরুণ খাজা মঈন উদ্দিন- এঁর আদব, বিনয়
ও আন্তরিক আতিথেয়তায় বুঝতে পারলেন যে, এ তরুণের মধ্যে সত্যের জন্য প্রবল তৃষ্ণা আছে।
এই সাধকের নাম শেখ ইব্রাহিম কান্দোজি। শেখ ইব্রাহিম কান্দোজি তাঁর নিজ থলে হতে একটা
রুটি বা খৈল বের করলেন। রুটিটি চিবিয়ে তিনি খাঁজা মঈন উদ্দিন- এঁর মুখে দিলেন। খাজা
কোন দ্বিধা না করে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলেন এবং অসাধারণ এক আত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করলেন।
এই দুনিয়া থেকে কিছু সময়ের জন্য তিনি বিচরণ করলেন পরমানন্দলোকে। ভাব জগত থেকে যখন তাঁর
প্রত্যাবর্তন হলো তখন আর খুঁজে পেলেন না সাধক শেখ ইব্রাহিম কান্দোজি-কে।
এই ঘটনার পর তাঁর চিন্তার জগতে একটা তীব্র
আলোড়ন শুরু হলো। ‘উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিশাল সম্পত্তি অভাবী ও দরিদ্রদের মধ্যে
বিলিয়ে দিয়ে তিনি গৃহত্যাগী হলেন। ২০ বৎসর বয়সী এক তগবগে যুবক তাঁর সর্বস্ব ত্যাগ করে
কপর্দকহীনভাবে একাকী লোকালয় ত্যাগ করে বের হলেন এলমে দ্বীন অর্জনের পথে এবং মানবেতর
প্রাণীদের মতো জীবন-যাপন শুরু করলেন। কোন পিছুটান না থাকায় তিনি একনিষ্ঠভাবে সাধনায়
নিমগ্ন হলেন। জ্ঞানের প্রবল পিপাসায় সমরকন্দ থেকে বোখারা, বোখারা থেকে খোরাসান ছুটলেন।
বোখারায় তিনি কুরআনের তফসীর, হাদিস ও ফেকাহশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তিনি প্রথাগত
ইসলামী শিক্ষায় সমরখন্দ ও বোখারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু জ্ঞানের
তৃষ্ণা যে কেতাবী বিদ্যায় মেটে না। তাই তিনি হাটতে থাকেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আধার অলি-মাশায়েখগণের
দরবারে, মাজারে। সত্যের সন্ধানে দরবার থেকে দরবারে ঘুরে তিনি এসে পৌঁছেন ‘হারুন’ নামক
গ্রামে। এখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় খাজা ওসমান হারুনী-এঁর সাথে। তিনি খাজা ওসমান হারুনী-কে
তাঁর মুর্শিদ হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং হযরত ওসমান হারুনীও তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ
করলেন। এরপর থেকে মুর্শিদের আদেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন এবং একনিষ্ঠ সাধনায়
নিমগ্ন থাকেন। একটানা ১৫ বছর তিনি তাঁর মুর্শিদের সাথে অবস্থান করেন।
খাজা উসমান হারুনীর বয়স যখন ৭০ বছর অতিক্রান্ত,
তখন খেলাফত প্রদান করে খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি-কে দ্বীন-এ মোহাম্মদী প্রচারের
জন্য ভারতবর্ষে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি আধ্যাত্মিকতায়
চিশতিয়া ধারার প্রচার এবং প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু চিশতিয়া ধারাটি শুরু হয়েছিল তাঁর
আগে। খাজা উসমান হারুনীর মুর্শিদ ছিলেন খাজা আবু ইসহাক শামী চিশতি। খাজা আবু ইসহাক
শামী চিশতি থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় চিশতি ধারা শুরু হয়। খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি
তাঁর মুর্শিদের মাধ্যমে চিশতি ধারায় দীক্ষিত হন এবং ভারতবর্ষে চিশতি ধারার ব্যাপক প্রচার
ও প্রতিষ্ঠা করেন।
নিজের ভক্তশ্রেষ্ঠকে ভারতবর্ষে প্রেরণকালে
খাজা উসমান হারুনী বলেছিলেন- ‘বাবা মঈন উদ্দিন সৃষ্ট জীবের কাছে কোন কিছু প্রত্যাশা
করবে না।’ নিজের মুর্শিদের এই উপদেশকে আদেশ হিসেবে গ্রহণ করে খেরকান, ওস্তারাবাদ, হেরাত,
সবজাওর, বলখ, গজনী, লাহোর, দিল্লী পার হয়ে তিনি আজমীরে পৌঁছেন। আজমীরে এসে তিনি যাত্রা
বিরতি করার ও আস্তানা স্থাপনের নির্দেশনা লাভ করেন। যতদিন মানুষের মাঝে মানুষকে নিয়ে
ছিলেন তিনি তাঁর মুর্শিদের আদেশ- ‘সৃষ্টজীবের কাছে কোন কিছু প্রত্যাশা করবে না’ বিস্মৃত
হননি। প্রত্যাশাহীন কর্ম করে গেছেন আজীবন। তাই লোকে তাঁর নাম দিয়েছে গরীরে নওয়াজ।
‘নওয়াজ’ অর্থ প্রতিপালক। তিনি ছিলেন আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার গরীবের প্রতিপালক
ও বন্ধু। আল্লাহ্ হচ্ছেন দাতা। যিনি অকারণে, অহেতুক, প্রত্যাশাহীনভাবে দিতে থাকেন তিনিই
আল্লাহ্। আল্লাহ্ বলছেন- তোমরা আমার রঙে রঞ্জিত হও। প্রত্যাশাহীনভাবে দিতে থাকাই আল্লাহ্র
রং। এই রঙে যিনি নিজেকে রঞ্জিত করেন তিনিই তাঁর পরিচয় লাভ করেন।
গরীবে নেওয়াজ খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি
আল্লাহ্র রঙে নিজেকে রঞ্জিত করেন। তাই লোকশ্রোতি আছে- ‘খাজার দরবারে কেউ ফেরে না খালি
হাতে’। খাজা, আল্লাহ্র চরিত্রে চরিত্রবান এবং রাহমাতুললিল আলামীনের উত্তম আদর্শের পরিপূর্ণ
বাস্তব উদাহরণ। এজন্যই মানুষ সম্পর্কে তাঁর কোন ভেদজ্ঞান ছিল না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে
অসহায় ও দিশেহারা মানুষ শান্তি লাভের আশায় ভীড় করেছে তাঁর দরবারে। ধর্মীয় অনুশাসন ও
আত্মিকভাবে গরীব মানুষ তাঁর কাছে থেকে সমভাবে উপকৃত হয়েছে এবং এখনও তাঁর নির্দেশনা
থেকে সঠিক পথের ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে।
আজমীরের প্রভাবশালী হিন্দুগণ নানা উৎপীড়ন
নিপীড়ন অত্যাচার করেও যখন তাঁর প্রচার প্রতিরোধ করতে পারেনি তখন তারা দিল্লি ও আজমীরের
নৃপতি পৃথ্বিরাজের কাছে খাজার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রেরণ করেন। এতে পৃথ্বিরাজ খাজার প্রতি
এক পত্র প্রেরণ করে খাজাকে আজমীর ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
খাজা পত্রের মর্ম অবগত হয়ে বাহককে বললেন,
‘আমি পৃথ্বিরাজকে জীবন্ত বন্দী করে শিহাবুদ্দিন ঘোরীর হাতে তুলে দিলাম’। এ কথা বলার
কয়েকদিন পরেই পৃথ্বিরাজ বন্দী হলেন শিহাবুদ্দিন ঘোরীর হাতে। উল্লেখ্য, কোন মুসলিম শাসকের
প্রচেষ্টায় বা শক্তির প্রভাবে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারিত
হয়েছে মূলত খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি এবং তাঁর পরবর্তী হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া,
শাহজালাল, শাহপরান, শাহআলী, শাহ সুলতান প্রমুখ সূফী সাধকদের প্রচেষ্টায়।
সুদীর্ঘ কালের সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের
ফলে খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন সে জ্ঞানের জ্যোতি ছড়িয়েছে
তাঁর কালজয়ী লেখার মাধ্যমে। কাব্যের অনুপম ছন্দে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর অর্জিত তত্ত্ব।
তিনি এক চিরঞ্জীব কবি ও সাহিত্যিক, তত্ত্বজ্ঞান ও দর্শন ভান্ডার। সূফীতত্ত্বকে যে অসাধারণ
বাক্যচয়নে তিনি প্রকাশ করেছেন তা সত্যানুসন্ধানী ও জ্ঞান-পিপাসুদের কাছে চিরন্তন আলোকবর্তিকা।
শুধুমাত্র একটা গজলে সাধক কবি মঈন উদ্দিন
হাসান চিশতি সূফীতত্ত্বের সবটুকু প্রকাশ করেছেন, শব্দের সীমানায় আবদ্ধ করেছেন অসীমকে।
তাঁর গজল পাঠে ব্যক্তি মানস হারিয়ে যেতে থাকে অসীম শূণ্যতায়। এমনই একটি গজলে খাজা আল্লাহ্কে
উদ্দেশ্য করে বলছেন-
‘আমরা তোমাকে অন্বেষণ করি আর তুমি আমাদের
থেকে পালিয়ে বেড়াও, আমরা তোমার দিকে ঝুঁকে থাকি আর তুমি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখো।
আমরা তোমার দিকে ঝুঁকে থাকি আর তুমি আমাদের
থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখো।
আমরা ছয়দিক থেকে বেড়িয়ে এসে শতদিকে তোমাকে
অন্বেষণ করি। আমাদের দিকে না তাকিয়ে আর কতকাল তুমি সবদিকে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে ?’
সত্যের অন্বেষণে ব্যাকুল আত্মার এটাই শ্বাশ্বত
প্রশ্ন। এই প্রশ্নের জবাবে কবি আল্লাহ্র জবানীতে গেয়ে উঠেন-
‘হে বেখবর, তুমি যেখানেই থাক না কেন, আমাদের
সাথেই আছো আমরা তোমাকে ছাড়া থাকি না, যদি না তুমি থাক আমাদের ছাড়া।
আমরা সমুদ্র, তুমি মেঘমালা, কাজেই বারি
বর্ষণের চিন্তা করো না। যদি তুমি অশ্রুজল ফেলো তবে তোমার বাগিচা হবে হাস্যোজ্জ্বল।
মারেফাতের নিগূঢ়তত্ত্ব আরো স্পষ্ট করার জন্য তিনি আবার পরম করুণাময়ের উদ্দেশ্যে বলেন-
‘তাকে বললাম, পর্দার অন্তরালে আর কতকাল গোপন থাকতে চাও?
সে সময় এসেছে যখন তুমি আমাদের কাছে চেহারা
ঢেকে রাখতে পারবে না।
আল্লাহ্ উত্তরে বললেন,- ‘আমি পর্দাবিহীন,
যদি কোন পর্দা দেখ তবে তা- ‘তুমিই’।
তুমি আছো হাজার পর্দায় ঢেকে আমাদের থেকে।
তুমিইতো তোমার হকিকত, কতদিন আর এনাম ওনামে
চলবে? (আমিত্বের আবরণ) এ এক অনর্থক অস্তিত্ব, তা তুলে নাও আমাদের থেকে।’
খাজার এই একটি মাত্র গজলে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার
সকল প্রশ্নের উত্তর। খাজা কেবল একজন কবিই নন, তিনি একজন জ্ঞানবান প্রবন্ধকার। খাজা
যেসব প্রবন্ধ তাঁর ভক্তশ্রেষ্ঠ, প্রধান খলিফা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকিকে উদ্দেশ্য
করে লিখেছেন, তাতে প্রকাশিত হয়েছে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দার্শনিক ও সূফীতাত্ত্বিক তাৎপর্য,
যা সাধনায় রত প্রত্যেকের জন্য আলোকবর্তিকা।
পঞ্চস্তম্ভের প্রথমে রয়েছে কালেমা তাইয়্যেবা।
কালেমা তাইয়্যেবা বা তওহিদতত্ত্বের হকিকত সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তার মর্মার্থ হলো-
মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু’ বললেই কালেমা
তাইয়্যেবার দায়িত্ব শেষ হয় না। কি বলা হচ্ছে তা হৃদয়াঙ্গম না করে শুধু মুখে উচ্চারণ
করলে তা মানবিক উচ্চারণই হয় না। ‘নাই কোন মাবুদ আল্লাহ্ ব্যতিত’- এ কথা উচ্চারণের আগে
প্রথমে জানতে হবে এর নিগূঢ়তত্ত্ব, তারপর নিজের জানাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে।
নিজের মাবুদগুলোকে নাই করতে পারলেই কেবল
‘ইল্লালাহু’ বলার তাৎপর্য আছে, অন্যথায় মুখে এই কালেমা পড়ার কোন তাৎপর্যই নেই। ‘লা
ইলাহা’ দ্বারা সাধক প্রথম নিজের আমিত্ব ও প্রবৃত্তির দাসত্বকে অস্বীকার করবে এবং ‘ইল্লালাহু’
দ্বারা আল্লাহ্ আমিত্বের প্রভুত্ব মেনে নেবে। ‘লা ইলাহা’ প্রবৃত্তির দাসত্বের স্তর
আর ‘ইল্লালাহু’ আল্লাহর প্রেমের স্তর। ‘ইল্লালাহু’ স্তরে প্রবৃত্তির দাসত্ব থাকতে পারে
না। তাই এই স্তরে শুধু ‘ইল্লালাহু’ আছে কিন্তু ‘লা ইলাহা’ বলার কোন অর্থ নেই। এই স্তরে
উপনীত হয়েই সাধকগণ শুধু ‘ইল্লালাহু’ জিকির করেন, ‘লা ইলাহা’ বলেন না। মুনসুর হাল্লাজ
এই স্তরে উপনীত হয়েই বলেছিলেন ‘আনাল হক’; বায়েজিদ বলেছিলেন ‘আমি-ই পবিত্র সত্তা’; ফরিদ
বলেছিলেন ‘আমি-ই সে’। তাই খাজা বলেন ‘মনে রেখো যে পর্যন্ত সালেক তার চিন্তাজগত থেকে
গায়রুল্লাহ্ খেয়াল দূরীভূত করতে না পারবে অর্থাৎ যে পর্যন্ত ‘লা ইলাহা’ না বলতে পারবে
সে পর্যন্ত সে মারেফাতের রাস্তায় এক কদমও অগ্রসর হতে পারবে না। আরেফ-কামেল আল্লাহ্কে
স্মরণ করাও বিস্মৃত হয়। কারণ, স্মরণও এক প্রকারের দ্বিত্ব এবং দ্বিত্ব আরেফের কাছে
কুফরি তুল্য। যে পর্যন্ত শিক্ষার্থী হকিকতের এ তত্ত্ব উপলব্ধি করতে না পারবে সে পর্যন্ত
সে তওহিদের মর্ম বুঝতে পারবে না এবং দ্বিত্বের সাগরে ডুবে থাকা অবস্থায় তওহিদভুক্ত
হবার দাবি করা বিলকুল মিথ্যাচার বলে প্রতিপন্ন হবে।’ এইভাবে একবার যে ব্যক্তি কালেমা
পড়তে পাড়বে নিশ্চয়ই শান্তি হবে তাঁর ঠিকানা।
ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত। খাজা সালাতকে
দুইভাগে বিভক্ত করেন। রুকু, সেজদা, কেয়াম, কেরাত সম্বলিত লোক দেখানো সালাত এবং আম্বিয়া
ও আউলিয়াগণের সালাত যা হুজুরি কালব্ সহকারে আদায় করা হয়। কুরআন প্রথমোক্ত সালাতকারীদের
জন্য অর্থাৎ লোক দেখানো নামাজীদের জন্য ধ্বংস নেমে আসবে বলে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে।
এ ধরনের লোক দেখানো নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্ পরিচয় লাভ করা যায় না। খাজা বলেন ‘লোক
দেখানো নামাজ একেবারে মূল্যহীন শারীরিক কসরত মাত্র। সাধকগণ হুজুরি কালব সহকারে হকিকি
সালাত করেন এবং তাঁরা সর্বদা নিজেদেরকে গায়রুল্লাহ্র খেয়াল থেকে মুক্ত রাখেন। তারা
সালাতে স্বীয় লতিফাগুলোকে আল্লাহ্র জেকের ও ফেকেরে মশগুল রাখেন এবং প্রতিটি নিঃশ্বাসের
হিসাব তারা রাখেন। তাঁরা ইয়াদে ইলাহি ব্যতিত কোন নিঃশ্বাস ছাড়েন না। এরাই প্রকৃত সালাতি।
সালাতের হকিকত হলো আমিত্বের আবরণগুলো উন্মোচন
করার প্রচেষ্টা। এই সালাত রুকু, সিজদা ও কেয়ামে সীমাবদ্ধ নয়। নিজের আল্লাহ্ ব্যতীত
চিন্তাজগত থেকে অন্য সকল চিন্তাকে দূরীভূত করা এবং চিন্তায় কেবলমাত্র আল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত
করাই সালাতের তাৎপর্য। এই সালাত নিশ্চয়ই সালাতকারীর জন্য মেরাজ অর্থাৎ আল্লাহ্ সাক্ষাৎ।
যে সালাতে মেরাজ হয় না তা লোক দেখানো নামাজ হয় কিন্তু কুরআনিক সালাত হয় না।
ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ সিয়াম। সিয়ামের তাৎপর্য
হচ্ছে নিজেকে দ্বিন এবং দুনিয়ার আশা-আকাঙ্খা থেকে মুক্ত করা। দ্বিনের আশা-আকাঙ্খা হচ্ছে
বেহেশতের আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও হুরের লোভ। এসব লোভ ও আশা-আকাঙ্খা সাধকের জন্য পরিত্যাজ্য।
কারণ, এসব আকাঙ্খাও আল্লাহ্ ও বান্দার মাঝে আবরণের সৃষ্টি করে। যতক্ষণ সাধকের মনে বেহেশতের
লোভ থাকে ততক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। দুনিয়ার প্রতি লোভ হচ্ছে অর্থ-বিত্ত,
নাম-যশ ও ক্ষমতার লোভ। এসব লোভ শেরেক পর্যায়ভুক্ত। খাজা বলেন ‘সিয়াম হকিকি তখনই সঠিক
হবে যখন মানুষ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সবকিছু চিন্তাজগত থেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়,
যাতে গায়রুল্লাহ্ ধারণা পর্যন্ত থাকে না এবং সব রকমের আশা ও ভয় থেকে চিত্ত মুক্ত হয়।’
সাধারণ মানুষ প্রথমে রোজা রাখে এবং রোজা
শেষে ইফতার করে। কিন্তু হাকিকি সিয়াম শুরু হয় ইফতার দিয়ে। সিয়ামের জন্য ইফতার শর্ত
নয় বরং ইফতারের জন্য সিয়াম শর্ত। সাধকের অবস্থা এমন নয় যে, তিনি বছরে একমাস সিয়াম বা
সংযম করবেন আর বাকী সময় সংযম ভঙ্গ করবেন। সাধকের সংযম একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তিনি
সংযম করেন কিন্তু কখনো তা ভঙ্গ করেন না। সাধকের ইফতার দিদারে এলাহি।
খাজা বলেন ‘মনে রেখো, যে ব্যক্তির শায়েখ,
মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক নেই তার দ্বিন নেই। যার দ্বিন নেই তার মারেফাতে এলাহি নেই।
যার মারেফাতে এলাহি নেই সত্যপথের পথিকদের সাথে তার সম্পর্ক নেই।
সত্যপথের পথিকদের সাথে যার সম্পর্ক নেই
তার কোন শুভাকাঙ্খী নেই। যার শুভাকাঙ্খী নেই তার কোন বন্ধু বা মাওলা নেই।’ যার মাওলা
নেই তার সিয়াম থাকবে কি করে?
সিয়ামের পরেই আসে যাকাতের প্রসঙ্গ। শরীয়তের
দৃষ্টিতে শতকরা আড়াই ভাগ অর্থাৎ ১০০ টাকার মধ্যে আড়াই টাকা অভাবীদের দেয়া যাকাত কিন্তু
তরিকতের দৃষ্টিতে আড়াই ভাগ নিজের জন্য রেখে বাকী সব বিলিয়ে দেয়া যাকাত। সুরা বাকারর
২১৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, ‘লোকে তোমাকে জিজ্ঞেস করে কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও উদ্বৃত্তের
সমুদয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে ‘উদ্বৃত্তের সমুদয়’ বলতে কি বুঝায়? উদ্বৃত্ত কি শুধু ধন-সম্পত্তি?
ধন-সম্পত্তি তো বাহ্যিক উদ্বৃত্ত। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে যা থাকে তা আর্থিক উদ্বৃত্ত।
আর কোন উদ্বৃত্ত কি মানুষের নেই? সন্তান জন্ম দেয়া ব্যতিত মানুষের কাম শক্তির সবটাই
উদ্বৃত্ত। এই উদ্বৃত্তের সমুদয় আল্লাহ্ উদ্দেশে উৎসর্গ করার নাম যাকাত। দৈনিক ৮ ঘন্টা
কাজের শেষে যে সময়টুকু থাকে সে সময়টুকুও উদ্বৃত্ত। এই উদ্বৃত্ত সময় আল্লাহ্র পথে ব্যয়
করার নাম যাকাত। একইভাবে, মেধা, বুদ্ধি, শারিরীক ও মানসিক শক্তিরও উদ্বৃত্ত আছে। কার,
কোথায়, কতটুকু উদ্বৃত্ত আছে তা তাকেই খুঁজে বের করতে হয় এবং এই উদ্বৃত্তের সমুদয় আল্লাহ্
পথে ব্যয় করার নাম যাকাত।
মুক্ত মানুষেরই যাকাত দেবার অধিকার আছে।
যে ব্যক্তি মুক্ত নয় তার যাকাত নেই। সুতরাং যাকাত প্রদানের পূর্বশর্ত হচ্ছে মুক্ত হওয়া।
যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির বন্ধনে আবদ্ধ তার প্রথম যাকাত হচ্ছে প্রবৃত্তিকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে
আনা। যে ব্যক্তি নফসের দাসত্ব করে সে কোন যাকাত দিতে পারে না।
যাকাত দিতে পারে কেবল সুস্থ মস্তিষ্কের
মানুষ। উন্মাদের উপর যাকাত দেয়ার কর্তব্য বর্তায় না। যে ব্যক্তি অনাবশ্যক বাক্য ব্যয়
করে, জীবনীশক্তিগুলোর অপচয় করে, সকালে এক কথা আর বিকালে অন্য কথা বলে, মিথ্যাচার ও
আত্মপ্রঞ্চনা করে, নিজের জিহ্বার উপর যার কোন নিয়ন্ত্রন নেই তাকে কি সুস্থ মানুষ বলা
যায়? একজন সুস্থ মানুষ হচ্ছে যে জানে সে কি চায়, যে জানে কেন সে জীবন যাপন করছে। একজন
সুস্থ মানুষের জীবন কর্মবৃত্তের একটা কেন্দ্র থাকবে।
একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে। লক্ষ্যহীন
জীবন হচ্ছে ‘ন’ ছাড়া জীবন অর্থাৎ জীবের জীবন, জীবের জীবন সুস্থ মানুষের জীবন নয়। সুতরাং
যাকাত দিতে হলে প্রথমে সুস্থ হতে হবে অর্থাৎ জীবনের লক্ষ্য বা কাবা ঠিক করতে হবে।
নাবালকের কোন যাকাত নাই। সাবালকের যাকাত
আছে। মানুষের নাবালকত্ব আর সাবালকত্ব বয়সের উপর নির্ভর করে না। নাবালকত্ব হচ্ছে নিজেকে
রক্ষা করার জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীলতা। মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের
উপর নির্ভরশীল থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে নাবালক।
যে ব্যক্তি তার প্রতিটি কর্মের জন্য ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ অর্থাৎ মানুষের গ্রহণশীলতার
উপর নির্ভরশীল থাকে সে সাবালক নয়। যে সাবালকই হয়নি তার যাকাতও নেই। সাবালকত্ব হচ্ছে
‘অনেষ্টি টু দ্যা পারপাস, সিনসিয়ারিটি টু দ্যা পারপাস’। সাবালকত্ব হচ্ছে দায়িত্ব ও
কর্তব্য পালনের যোগ্যতা। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের পরিপূর্র্ণ দায়িত্ব নিজে নিতে
না পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য
পালনে তার নিষ্ঠা, সততা ও একাগ্রতা প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে সাবালক বলা
যায় না।
পঞ্চস্তম্ভের শেষ স্তম্ভটি হজ। হজে কাবাকে
প্রদক্ষিণ করতে হয়। খাজা বলেন ‘ইনসানের দেল খানায়ে কাবা এবং মোমিনের দেল আল্লাহ্র আরশ।
এ দেল কাবার হজ করা প্রয়োজন।’ এই দেল কাবার হজ সম্পন্ন করতে হয় ‘ইন্দ্রিয়সমূহের নিকট
আগমনকারী সকল বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা ঘটিত সকল কর্ম সূক্ষèভাবে দর্শন করার
মাধ্যমে।’
ইন্দ্রিয়সমূহ বহির্মুখি। ইন্দ্রিয়সমূহের
বর্হিমুখিতাই চিত্তচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এই চিত্তচাঞ্চল্যের প্রভাবে মানুষ অশান্ত
হয়। ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য শব্দ, দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শ প্রবেশ করে নিজের ভেতরে।
প্রতিটি শব্দ, দৃশ্য, স্পর্শ, গন্ধ, স্থান করে নেয় অস্তিত্বে, সৃষ্টি করে মিথ্যা আমিত্ব।
ফলে, স্তরে স্তরে আবৃত হয় এক, একক এবং অদ্বিতীয় ‘আমি’। মিথ্যা আমিত্বের আবরণ উন্মোচন
করলে অপরিবর্তনীয় আমির সাক্ষাৎ মেলে। তাই খাজা বলেন, ‘সন্দেহ, গোমরাহি ও গায়রুল্লাহ্
পর্দা দূরীভূত করলে দেলরূপ আয়নায় আল্লাহ্ জাতের জলোয়া প্রত্যক্ষ নজরে আসবে। এটাই খানায়ে
কাবার হজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ রকম হকিকি হজের আরো একটা বিশেষ উদ্দেশ্য হলো ইনসান
মিথ্যা আমিত্বকে এমনভাবে মিটিয়ে দেবে যেন এই আমিত্বের কোন নাম-গন্ধও অবশিষ্ট না থাকে।
এ পর্যায়ে সে ভেতর-বাহিরে সমভাবে পবিত্র হবে এবং দেল আল্লাহ্ সিফাতে গুণান্বিত হবে।’
খাজা লিখেছেন ‘এরপর উমর জিজ্ঞেস করলেন, কাবায়ে দেলের হজ কে সমাধা করে? রসুল সা. উত্তরে
বললেন, ‘কাবায়ে দেলের হজ একমাত্র খোদ মহিমান্বিত সত্তা সমাধা করে থাকে। অর্থাৎ বান্দা
যখন নফসের বন্দেগিরূপ পর্দা দূর করে দেয় এবং আবেদ ও মাবুদের মধ্যে যখন কোন পর্দা অবশিষ্ট
থাকে না তখন সে সিফাতে এলাহিতে সামিল হয়ে যায় এবং তখন তার দেলে জাতে এলাহি প্রকাশ পায়।
বান্দার দেলে আল্লাহ্ জাতের প্রকাশ হওয়াই কাবায়ে দেলের হজ বা হকিকি হজ।’
‘কেউ ফেরে না খালি হাতে খাজা তোমার দরবারে।’
খাজার দরবারে চাইতে জানলে এখনো কেউ খালি হাতে ফেরে না। কিন্তু এসব চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারে
খাজা বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে চিনতে সক্ষম হয়েছে সে কখনো আল্লাহ্ কাছে কিছু চায় না।’
এইসব চাওয়া পাওয়া থেকে যে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছেন তিনিই আল্লাহ্ পরিচয় লাভ
করেন।
খাজা বলেন
‘নিজের সম্মুখ থেকে চাওয়া-পাওয়ার নেকাব
তুলে ফেলো
হৃদয়ের আয়নায় তুমি মাওলার সৌন্দর্য দেখো।
সাধুতার কাঁচ দিয়ে আঘাত কর ভৎসনার পাথরে
তাকওয়ার মর্যাদাকে ঢেলে দাও প্রেমালয়ে।’
খাজার এই আহ্বান আঘাত করে অস্তিত্বের অতলান্তে।
তাই তাসাউফ ভুবনে খাজা চিরঞ্জীব, অবিস্মরণীয়। প্রায় হাজার বছর ধরে সত্যানুসন্ধানীরা
তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ দিয়ে আসছেন। পৃথিবীতে মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন এ ধারাও থাকবে অব্যাহত।
খাজা বলেন
‘প্রেমাস্পদ এমন আগুন জ্বালিয়েছে যা
আমার দেহ ও প্রাণ পুড়ে ফেলেছে,
ভাবলাম, আহ্ করে চীৎকার দেবো,
অমনি আশা ও ভাষা পুড়ে গেছে।
বিরহ অনলের তাপ ও জ্বালা দোজখের আগুনেও
নেই
হায়! এ আগুন আমার ভেতরটাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
দোজখের আগুন দগ্ধ করে শুধু গুনাহ্গারদের
চামড়া তাঁর বিরহের আগুন দগ্ধ করেছে আমার হাড়ের ভেতরের মজ্জা।
হৃদয় দোজাহানের নেয়ামত ও তার পরিণাম কামনা
করেছে
প্রেমাস্পদের আগুন এসে আমার
দোজাহানই পুড়ে ছাই করেছে।
দুনিয়া ও আখেরাত চলে যাক্,
শুধু মাওলার প্রেম থাকাই যথেষ্ট।’
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল তাঁর
জন্য তাঁর আল্লাহ-ই যথেষ্ট। আমিন। (পুনঃপ্রকাশিত)
চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালোশশী
হব বলে চরণদাসী ও তা হয় না কপালগুণে ॥
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন লুকালে না পায়
অন্বেষণ কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে ॥
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয় থাকে না লোকলজ্জার
ভয় লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে॥
‘মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে।’
প্রত্যেকের অহম বা আমি (ইগো) যেখানে রয় তাকে আমার বলা হয়। এই মায়াবৃত আমির মান হীন
বা কম; তাই এই আমির জ্ঞান অনুমানভিত্তিক। এই আনুমানিক আমি মনের মানুষ অর্থাৎ পরম আমি
বা প্রামাণিক আমির সঙ্গে জ্ঞানালোকের সাহায্যে সংযুক্ত হতে চায় যা সাঁইজির ভাষ্যে ‘মিলন
হবে কতদিনে/আমার মনের মানুষের সনে।’ ‘চাতক প্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালো শশী হব বলে
চরণদাসী ও তা হয় না কপালগুণে।’ এখানে চাতক
ও প্রায় শব্দের মর্মার্থ বুঝে নিতে হবে। মেঘজল প্রার্থনাকারী হল চাতক এবং নাওয়াখাওয়া
ইত্যাদি প্রতিদিনের কাজ ত্যাগ করার নাম প্রায়। অর্থাৎ ভোজন পরিত্যাগ করে রাতদিন বৃষ্টির
জন্য হাপিত্যেশ করাকে ‘চাতক প্রায় অহর্নিশি’বলা হয়েছে। আর এই অনশনব্রত পালন করা হচ্ছে
কালোশশীর জন্য। কৃষ্ণচন্দ্রই হল কালোশশী; যিনি চন্দ্রের মতো আনন্দকর। কৃষ্ণ শব্দের
মধ্যে কৃষ ধাতু আছে যার অর্থ ‘যিনি প্রলয়ে বিশ্ব আপনাতে আকর্ষণ করেন।’ চাতকের মতো জীবসত্তার
সেই পরমপুরুষের আকর্ষণে আকৃষ্ট হবার মানসিকতাকেই সাঁইজি চেয়ে আছে কালোশশী’ – বলেছেন। দাসের মধ্যে দান, অর্পণ বা আত্মনিবেদন জড়িত। সবিনয়
নিবেদনে পরমের চরণ বা গতির মধ্যে বিলীন হওয়াকে ‘হব বলে চরণদাসী’রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
তবে তা সম্ভব হচ্ছে না কপালগুণে। কপাল শব্দটিতে ‘ক’ ও ‘পাল’ বিদ্যমান। ক মানে ব্রহ্ম
(মনের মানুষ) পাল মানে (পালন) অর্থাৎ ব্রহ্ম যেখানে পালিত হয় তার নাম কপাল। প্রতীকী
অর্থে যা শিরোরক্ষক হিসেবে অভিহিত। উল্লেখ্য শিরই জ্ঞানের আধার; যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান
পালিত ও পুষ্ট হয়। অপর দিকে বন্ধন বা বাঁধনকে গুণ বলে। তা হলে জীব বা রাধাসত্তা পরম
বা কৃষ্ণসত্তার সঙ্গে ঐক্য গড়তে চাইলেও ব্রহ্মজ্ঞান বন্ধনযুক্ত থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে
না। এই অবস্থাকেই লালন ও তা হয় না কপালগুণে’বলেছেন। ‘মেঘের বিদ্যুৎ
মেঘেই যেমন লুকালে না পায় অন্বেষণ কালারে হারায়ে
তেমন ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।’ মেঘের ইচ্ছা জল, জলের ইচ্ছা বিদ্যুৎ। এই এষণা বা
ইচ্ছাগুলো মেঘ-জল-বিদ্যুতে একাকার থাকে। ইচ্ছাগুলো প্রকাশিত না হয়ে গুপ্ত থাকলে অন্বেষণ
বা সন্ধান পাওয়া যায় না। এর প্রতিফলন নিজের দুই চরণে প্রতিফলিত মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই
যেমন/লুকালে না পায় অন্বেষণ।’ কৃষ্ণরূপী মহাকাল সত্তাই হল কালা। এই দেহেই জীব ও পরম
জুটি মেঘ-বিদ্যুৎ জুটির মতো মিলেমিশে আছে। বিদ্যুৎরূপী পরম মাঝে মাঝে ঝিলিক দিলেও ব্রহ্মজ্ঞান
লব্ধ না হওয়ার কারণে সেই পরমপুরুষ বা মহাকাল ‘কালা’ অদৃশ্যমান থেকে যায় যার সাঁইজীয়
ভাষ্য ‘কালারে হারায়ে তেমন।’ তা সত্ত্বেও সেই শ্রীকৃষ্ণের রূপ এই দেহের আদর্শে বা আরশিতেই
দেখা যায় যাকে লালন বলেছেন ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।’ ‘ঐ রূপ যখন স্মরণ হয় থাকে না লোকলজ্জার ভয় লালন ফকির ভেবে বলে সদাই ও প্রেম যে করে সেই জানে।’ জীব যখন সেই পরমরূপ ভজন বা ভাজক করে নিজেই পরমের
অংশী হয় তখন নির্বিকার পরমাত্মিক চেতনার দর্শন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা যাকে ‘লজ্জা’
বলা হয়েছে তা দূর হয়, পরম আকর্ষণীয় সত্তাকে (কৃষ্ণ) প্রিয় বা পতিরূপে বরণ করলে যে অনুরাগের
সূচনা হয় সেই অনুরাগই জীবকে (রাধা) পরমের যানে উঠিয়ে দেয়। এই অনুরাগী পরমপুরুষ সম্পর্কে
অবগত হয়।
লালন ফকিরের আত্মজ্ঞানের নিত্য অনুসন্ধানী
দৃষ্টি তাই বলে। যার লালন সুভাষণ ‘লালন ফকির ভেবে বলে সদাই/ও প্রেম করে সেই জানে।’
(সমাপ্ত)
শাহ্ মো. লিয়াকত আলী ॥ ‘আমিত্বের আবরণ দুর করার প্রচেষ্টার অপর নাম এবাদত’ – সূফী সাধক আনোয়ারুল
হক।
সাধক তাঁর এ বাণীতে স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে
বাস্তব জীবনের এবাদত কি এবং তা কিভাবে করা যায়? তারই স্পষ্ট দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন
তাঁর এ মহান বাণীতে। এ বাণী থেকে বুঝা যায় আমিত্বের আবরণ ধারণ করে আর যা কিছু করা যাক
কখনো এবাদত নামক কর্মটি করা যায় না। তাই এবাদত নামক কর্মটি যথাযথ ভাবে করতে হলে এর
মৌলিক বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। বুঝা দরকার আমিত্ব কি? আমিত্বের আবরণ কিভাবে
হতে থাকে? আমিত্বের আবরণ দুর করার প্রচেষ্টার কিভাবে করা যায়? মানুষের এবাদত করার প্রয়োজন
ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? এবাদত করার জন্য এইসব বিষয় বুঝা দরকার।
আমি এবং ত্ব এ শব্দ দু’টি যোগ করে আমিত্ব
শব্দটি লিখা হয়। আমি শব্দটিতে একবচন নিজ সত্ত্বাকে বুঝায়। ত্ব শব্দটিতে ব্যক্তির গুণাবলীর
বিষয় বুঝায়। কাজেই আমিত্ব শব্দটিতে আমির গুণাবলী তথা নিজের গুণাবলীকে বুঝায়। আমির গুণাবলী
তথা নিজের গুণাবলী প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের পরিচয় তুলে ধরতে পারেন। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ
যুগে যুগে বলেছেন,’ নিজেকে চেন। আবার শাস্ত্র
মতে বলা হয়, ‘যে নিজকে চিনতে পারেন, সে ব্যক্তি তাঁর স্রষ্টাকেও চিনতে পারেন। ‘তাই
বলা যায় কেহ নিজের পরিচয় সম্পর্কে সঠিক সমাধান বের করতে পারলে সে ব্যক্তির নিকট তাঁর
স্রস্টার সৃষ্টির সকল রহস্যের সমাধান সহজ হয়ে যাবে।’
ব্যক্তির ভুমিষ্ঠ ও বেড়ে ওঠার সাথে সাথে
তার পারিবারিক সামাজিক ও অন্যান্য জীবনের সম্পর্ক, জনবল, বিত্তবল, শিক্ষা, চাকুরী,
ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোন কর্মগুণাবলীর পরিবর্তনের প্রকাশ ও বিকাশ সাধন হতে থাকে। এ সকল পরিবর্তনের হ্রাসবৃদ্ধির ক্ষমতা যখন ব্যক্তির
নিজের কাছে ধরা পড়ে তখন ব্যক্তির আত্মবলের সমানুপাতিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। এ আত্মবল
যতবার পরিবর্তিত হতে থাকে, ব্যক্তির পূর্ব পরিচিতির উপর ততবারই এর কিছুটা প্রভাব পড়তে
থাকে। এর ফলে পরিবার ও সমাজের নিকট ব্যক্তির নুতন পরিচিতির বিস্তার ঘটতে থাকে।
পরিবার ও সামাজিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে
একজন মানব শিশুর পরিচয় তুলে ধরার জন্য প্রথমে পায় একটি নাম, অতঃপর পিতা মাতা ভাইবোন
দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচী, বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী ইত্যাদি সহ বিভিন্ন মহলে
পরিচিতির জন্য লাভ করতে থাকে বি.এ, এম.এ, এসব বিভিন্ন ডিগ্রি। চাকুরীর ক্ষেত্রে দারোয়ান
পিয়ন সুপারভাইজার, সেকশন অফিসার, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাপরিচালক এভাবে প্রশাসন
ও রাজনৈতিক অঙ্গনে একইভাবে বিভিন্ন পরিচিতি তুলে ধরার জন্য পায় বিভিন্ন খেতাব ও পদবী।
এ সকল সাময়িক কর্মপদবীর মাধ্যমে মানুষের আচরণের সাময়িক কর্মপরিচিতি প্রকাশ পেলেও, স্থায়ী
জীবন পরিচিতির প্রকৃত পরিচয় বহন করেনা। সাময়িক কর্মপরিচিতি মানুষে মানুষে উঁচু নীচু,
অমির ফকির, ধনীগরিব এসব ভেদাভেদ তুলে ধরে। যা মানুষ হিসেবে সবাই সকলের মর্যাদাকে একইভাবে
সমুন্নত দেখতে পায়না। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী এসকল গুণাবলীর পরিচিতির মাধ্যমে
সৃষ্টি হয় মানুষের ইগো বা মিথ্যে অস্থায়ী পরিচয়। মানুষের এ অসুস্থ অস্থায়ী পরিচিতির
এক এক স্তরের গুণাবলী হতেই সৃষ্টি হয় মানুষের আচরণে আমিত্বের আবরণ।
মানুষের অস্থায়ী দেহকেন্দ্রিক ঋণাত্মক
আচরণের প্রভাব যেমন তার জীবনকে আমিত্বের আবরণে আবৃত করে থাকে তেমনি ভাবে আত্মকেন্দ্রিক
আচরণের ধনাত্মক পরিবর্তন অনাবৃত করতে পারে ব্যক্তির জীবনের আমিত্বের আবরণ। আত্মকেন্দ্রিক
আচরণের ধণাত্মক পরিবর্তন বলতে বুঝায় সকলের আত্মার রয়েছে সত্যময় ক্ষমতাসম্পন্ন স্রষ্টাকে
অনুভব করা ও বুঝার সুষম-ক্ষমতা। এ ক্ষমতার উপযুক্ত ব্যবহার করে ব্যক্তি চাইলে সমুন্নত
মর্যাদা সম্পন্ন স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি সদ্ব্যবহার পূর্বক আনন্দ ও শান্তিময় জীবন উপভোগ
করতে পারেন। কারণ সকল ব্যক্তির আত্মাই হলো সমউপযোগী সমমর্যাদা ও সমক্ষমতা সম্পন্ন সুবিচারক
মহান স্রষ্টার সৃষ্টি। স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদা সম্পন্ন আচরণ প্রদর্শন
করার উপযোগী গুণাবলী সম্পন্ন আত্মাই হলো মানব জীবনের প্রকৃত পরিচিতি বা স্থায়ী আমিত্ব।
ব্যক্তির এ স্থায়ী আমিত্বের প্রভাব ও পরিচয় তুলে ধরার জন্যে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী
আচরণের মাঝে সৃষ্ট যে সকল অসুস্থ অস্থায়ী পরিচয়ধারী আমিত্বের আবরণ গড়ে ওঠে, ব্যক্তির
স্থায়ী আমিত্বকে এসব সৃষ্ট আবরণের প্রভাবমুক্ত করার অব্যহত প্রচেষ্টাকেই সাধক এবাদত
হিসাবে গণ্য করেন।
শান্তি ও আনন্দ ব্যক্তির জীবনের এমন এক
সম্পদ যা উপভোগ করে কেহ কখনও ক্লান্ত বা অবস্বাদগ্রস্থ হয়না। তাই ব্যক্তি তার অনন্তকালীন
জীবনকে শান্তিময় আনন্দলোকের মাঝে যাপিত করতে চাইলে নানান পরিচয়ধারী আবৃত জীবনকে আমিত্বের
আবরণমূক্ত করা অত্যাবশ্যক। এ কর্মটি সুসম্পন্ন করার জন্যই মানব জীবনে এবাদতের ভূমিকা
বিশেষ ভাবে অনন্য। (চলবে)
শাহিনুর আক্তার ॥ ভোলা দরবার, নিঝুম দ্বীপ,
দ্বীপের মাটিতে চোখ বুজে তাঁর শুয়ে থাকা। ভোলা দরবারে বড় পুকুরে একটা ‘জলযান’ প্রস্তুত
ছিল। ফুলের উপাচারে সজ্জিত। মামার জন্য আসন পাতা। সকলে বারে বারে তাঁর জলযানে সঙ্গী
হচ্ছিলো আর প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে সমেবেত স্বরে। আমার ছোট ছেলেটা বিরক্ত করছিল
তাই আমি দরবারে কক্ষেই ছিলাম। বের হলাম দেখলাম পুকুর থেকে বড় বড় মাছ তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন
মানুষ নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত। আমার ছেলে বললো আম্মু নানাভাই তো পুকুরে খুব মজা করছেন।
সবাইকে চড়িয়েছেন, তুমিও যাও। ছোটকে নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। মামা ভীষণ খুশি ছিলেন, বেশ
হাসিখুশি। আমাকে ছোট’র নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম ‘সালেহ আল রাজীন’। শুনে বললেন
ভালো হয়েছে। জুবায়ের জী জলযানের সাথে ভাসছিলেন। দড়ি দিয়ে জলযানকে টেনে টেনে ঘুড়িয়ে
আনা হচ্ছিল। মামার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই হাসিমুখ
অদ্ভত ভালোলাগা যেন মনে রঙ্গিন প্রজাপতির মত। নিঝুম দ্বীপের নৌকায় যেতে যেতে যে নৈস্বর্গের
ছোঁয়া মানুষের চোখে ধরা পড়েছে তা কল্পনাতীত। এমন কাফেলা এমন মহামানবের রহমতের ছোঁয়া
পাওয়া এ জীবনে হবে না, এযে তোমার অপার রহমতের ধারা।
০১/০৪/১৯ইং পাইকপাড়া দরবার – এ সত্যব্রত
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করি। আমার সাথে আমার ছোট ছেলে ছিলো। আমার পাশে বসা ছিল। কিন্তু
বার বার সে মামার কাছে চলে যাচ্ছিল । স্বেচ্ছাসেবী যারা ছিল ওরা সামলাতে পারছিল না।
আমিও তাকে আটকাতে পারছিলাম না। বিরতি পর্বে আমার মায়ের বাড়ি চলে আসি। ০৩/০৪/১৯ইং চলছে
রজব মাসব্যাপী অনুষ্ঠান। আমি দরবারে খুব একটা উপস্থিত হতে পারি না। বৃহস্পতিবার মিলাদে
আমার জন্য এতটা চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ভাবিনি। মিলাদ প্রায় শেষ তখন মাসুম এসে
বললো, আপনি শাহিনূর আপনার বাসা ফার্মগেট? বললাম
হ্যা। আবার প্রশ্ন, আপনার ছোট ছেলেকে আনেননি? আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, না আনিনি।
মাসুম বললো, মামা বলে পাঠিয়েছেন – মিলাদ শেষে দেখা না করে যাবেন না। আমি অপেক্ষা
করছিলাম যাব। অবাক করে উঠে, মহিলা কক্ষে নিজেই চলে এলেন। হাস্বোজ্জল মুখে বললেন, ‘এতদিন
কোথায় ছিলেন? আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আপনার ছেলেটিকে কেন আনেন নি? এখন সম্পর্ক
আমার ওর সাথে। পাইকপাড়া দরবারে ও আমার পায়ে
চুমা খাচ্ছে। হাত দিয়ে পায়ে আদর করছে।’ কথাগুলো যখন বলছিলেন মামাকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।
তাঁর চোখ -মুখ দেখে আমার ভেতরে এত আনন্দ হচ্ছিল, পৃথিবীর সমস্ত খুশি, সমস্ত সম্পদের
অধিকারী, শান্তি , সুখ, আনন্দ যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমার মত দীনহীন তুচ্ছ প্রাণীর
জন্য এ প্রাপ্তির কোন মূল্য হয় না। জাগতিক পরিমাপক একে পরিমাপ করতে পারে না।
পরের দিন ক্ষুদে হাক্কানীকে নিয়ে গেলাম। মামার জন্য ছোট ফুলের তোড়া নিয়ে গেল। একজন সত্যমানুষ
অন্যজন শিশু তাই দু’জনের আলাপচারিতায় শিশুসুলভ সৌন্দর্য যেন ঝরে পড়ছে। রাজীন মামার পাশে বেশ শান্ত ভাবে বসে আছে। নানা ভাইয়ের কাছ থেকে চকলেট উপহার
পেয়ে সে বেশ খুশি। মিলাদ শেষে মামা রাজীনের
সাথে করমর্দন করতে করতে বললেন, ‘আগামীকাল রজবের শেষ, কালকে আবার আসবেন।’ মাথা দুলিয়ে
সম্মতি জানালো রাজীন।
পরের দিন দু’জনকে নিয়ে গেলাম। নানাভাইয়ের
আদর পেয়ে ভীষণখুশি সে। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে এলাম।
একরাশ ভালোলাগা নিয়ে। এত আনন্দ জীবনে হইনি। এত প্রাপ্তিও কখনো ঘটেনি। এত আর্শীবাদ
পেয় আমি ধন্য।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক আর্শীবাদপুষ্ট বাংলাদেশ
হাক্কানী খানকা শরীফ (বাহাখাশ) বার্ষিক সাধারণ সভা ২০১৮ইং নিমন্ত্রণ পাই। সময়টা ছিল ১৪/০৬/১৯ইং রোজ শুক্রবার। একটু আগেভাগে
চলে যাই। যেয়ে দেখি মামা সামনের সারিতে বসে আছেন, নতুন কমিটি গঠন করায়ে, এগারজনের নবগঠিত
কমিটিতে আমার নাম ঘোষনা করা হয়। আমি ভীষণ ভাবে চমৎকৃত হই। তাঁর সাথে ছিল শেষ সাক্ষাত।
মামাকে সামনা সামনি আর দেখিনি। বাহাকাশ চান্দপুর শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষ বেলায়, মামার সাথে দেখা
হয়নি। আর সৌভাগ্য হলো না তাঁর সেই দ্বীপ্তিময় মুখশ্রী দেখার। আর হলো না। তাকেই তো রাগের ভাষায় কথা বলা যায়। যে আমার আপনার
আপন আত্মার আত্মীয়। কেন বুঝতে পারিনি কেন তাঁর কাছে বারবার আসিনি। কেন দূরে থেকে অভিমান
পুষেছি। আজ কেন আফসোস করছি কেন কাঁদছি। এখন এই ব্যাকুলতার জন্য দুঃখ হয়। তাঁর চলে যাওয়া বড় বুকে বাজে। তাঁর দর্শনরূপের স্বচ্ছ
কাঁচের ভেতর আচ্ছাদিত গিলাফের ফুলের ঝালর বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। আমি সেই বিশাল শুভ্র
অবয়বে আপনার স্নিগ্ধ হাসিমাখামুখ দেখতে চাই। আমাদের ভুলের জন্য বজ্রকন্ঠের সেই হুংকার
শুনতে চাই। আমাদের বেদনাতুর চোঁখে স্নেহের পরশ পেতে চাই। ভীষণ কষ্ট লাগে, ভীষণ কষ্ট…….
‘সাজানো ফুলের বনে ঝড় বয়ে গেল
সে ঝড় থামার পরে
পৃথিবী আধার হলো
তবু দেখি দ্বীপ গেছো জ্বেলে।
তুমি চলে গেলে…. ’
৫ শ্রাবণ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ ২০ জুলাই ২০১৯ইং
সূফী সাধক শেখ আবদুল হানিফ লোকান্তরিত হন।
‘মৃত্যু বলে কিছু নেই আছে রূপান্তর
অনন্ত অসীম স্রষ্ঠা অ-জড় অমর।’
শ্রাবণ যেন আমাদের কাছে করুণার ধারার মতোই বইয়ে দিলো। অনন্ত কাল ধরে। যত দিন পৃথিবীর বুকে
হাক্কানীর ধারা অব্যহত থাকবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকার ইয়েমেন যুদ্ধ সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ব্যাপারে যুদ্ধে জড়িত পক্ষগুলোর মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম পদক্ষেপেই ইয়েমেনের আনসারুল্লাহর ওপর থেকে অবরোধ এক মাসের জন্য তুলে নিয়েছে। মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, জো বাইডেন কংগ্রেসকে জানিয়েছেন যে, আনসারুল্লাহকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মারফি বাইডেনের
সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এর আগে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কির্বিও বলেছিলেন, ইয়ামেন
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র রিয়াদকে সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
বাইডেন সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলোকে বেশিরভাগ
কৌশল বলেই মনে হয়। কৌশলটা হলো আনসারুল্লাহ’র সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। কেননা
এটি বর্তমানে ইয়েমেনের সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। অবশ্য এই সিদ্ধান্তগুলো কৌশলগত
হলেও এর ইতিবাচকতা রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে নয়া মার্কিন প্রশাসন আনসারুল্লাহকে ইয়েমেনের
প্রভাবশালী একটি দল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অপরদিকে বাইডেন সরকারের এই সিদ্ধান্তের
প্রতি আনসারুল্লাহর প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। আনসারুল্লাহ এই সিদ্ধান্তগুলিকে স্বাগত জানিয়ে
এই ‘ঘোষিত’ নীতিকে ‘প্রায়োগিক’ নীতিতে রূপান্তর করার আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন সরকার গত ছয় বছর ধরে ইয়েমেনের
বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। আমেরিকাকে বিশ্বাস করা দুরূহ ব্যাপার।
সুতরাং আস্থা সৃষ্টির জন্য যুদ্ধ বন্ধ করতে সৌদি আরবের উপর চাপ সৃষ্টি করার দাবি জানিয়েছে
আনসারুল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে ইয়েমেনের সর্বোচ্চ বিপ্লবী
কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আল-হুথি বলেছেন: ‘আমরা বর্তমানে বাইডেনের অবস্থানকে
একটি মৌখিক বিষয় হিসেবে নিয়েছি। আমরা যুদ্ধের অবসান এবং অবরোধ তুলে নেয়ার অপেক্ষায়
রয়েছি। ওয়াশিংটনের মদদপ্রাপ্ত সৌদি ও আরব-আমিরাত আগ্রাসন বন্ধ করবে বলে আশা করছি।”
ইয়েমেনে সৌদি হামলা চালিয়ে যাওয়া এবং সৌদি
নৃশংসতার ধারাবাহিকতার কারণেই আমেরিকার ব্যাপারে এ ধরনের আস্থাহীনতার মতো প্রতিক্রিয়া
আনসারুল্লাহর।
সৌদি আরব অবশ্য বাইডেন সরকারের সিদ্ধান্তের
ব্যাপারে নীরব রয়েছে। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত দাবি করেছে, তারা গত দেড় বছর ধরে ইয়েমেন
যুদ্ধে জড়িত ছিল না। তারা ২০২০ সালের অক্টোবরের পর থেকে ইয়েমেনে সামরিক উপস্থিতির অবসান
ঘটিয়েছে।
যাই ইয়েমেন যুদ্ধে বর্তমানে আনসারুল্লাহ
শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এমনকি কৌশলগত প্রদেশ মার্বেও তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার
পথে রয়েছে। সুতরাং বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত বরং সৌদি জোটকে ইয়েমেন যুদ্ধের চোরাবালি
থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।
মার্কিন সরকার ও মিডিয়ার প্রতি জনগণের
ব্যাপক অবিশ্বাস : হোয়াইট হাউজ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও গণমাধ্যমের
প্রতি জনগণের অবিশ্বাস ও অনাস্থা দিনকে দিন বাড়ছে। এমনকি হোয়াইট হাউজও এ বিষয়টি স্বীকার
করেছে।
মার্কিন সরকার, সার্বভৌমত্ব ও মার্কিন
গণমাধ্যমের প্রতি এই অবিশ্বাসের কারণ হল সেখানকার সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট-নির্বাচন-পরবর্তী
নজিরবিহীন সহিংসতা, অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনা
ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার।
হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেনিফার সাকি বলেছেন,
সরকার, সংবাদ মাধ্যম ও তথ্য-উপাত্ত এবং পরিসংখ্যানের প্রতি মার্কিন জনগণের মধ্যে
ব্যাপক অবিশ্বাস বিরাজ করছে। তিনি বলেন, কোন্টি সঠিক ও কোন্টি সঠিক নয় এবং বাস্তবতা
ও বাস্তবতা নয় তা বোঝা যাচ্ছে না!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকার
প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বলে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র দাবি করেন।
হোয়াইট হাউজের স্বীকারোক্তি থেকেই স্পষ্ট
মার্কিন সরকার ও গণমাধ্যমের প্রতি মার্কিন জনগণের
অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। এর অর্থ মার্কিন জনগণের মনে দেশটির সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে।
এই সংকটের এক বড় কারণই হল সাম্প্রতিক মার্কিন
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে
বলে পরাজিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ। কেবল তাই নয় ট্রাম্প বলেছেন, মার্কিন
রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি নির্বাচনে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থাকেও প্রশ্নের
সম্মুখীন করেছেন। ট্রাম্পের মতে এবারের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল এবং তার পরোক্ষ
আহ্বান ও উসকানিতে একদল উগ্র সমর্থক গত ছয় জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে অভ্যুত্থানের
স্টাইলে ভয়াবহ হামলা চালায়।
আর এ বিষয়টি দেশটির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের
বৈধতাকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলের
সমর্থক ও দেশটির রক্ষণশীলদের মধ্যে এখন দিনকে দিন দূরত্ব বাড়ছে এবং উভয় পক্ষের বুদ্ধিজীবী
সম্প্রদায়ের মেরুকরণ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ফলে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বাড়ছে
দেশটির জনগণের অনাস্থা।
মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা দেশটির
ঘরোয়া সন্ত্রাস ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা জোরদারের ইঙ্গিতও তুলে ধরেছে। এ ছাড়াও ট্রাম্প
সরকারের উদাসীনতার কারণে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে মারা গেছে প্রায় ৫ লাখ নাগরিক ও করোনায়
আক্রান্ত হয়েছে দুই কোটি আশি লাখ মানুষ। ট্রাম্প সরকারের সময় বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক
মন্দার কারণে দেশটিতে দারিদ্র ও ক্ষুধা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। আর এই অবস্থামোকাবেলা
করা এখন বাইডেন সরকারের কর্মসূচির প্রধান অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে
বড় সমস্যা হল মার্কিন ডেমোক্রেট দলের সমর্থক ও রিপাবলিকানদের মধ্যে বিতর্ক এখনও চলছে।
বাইডেন সরকার এক দশমিক নয় ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েছে তার বিপক্ষে
ভোট দিয়েছে সব রিপাবলিকান সিনেটর!
মার্কিন রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে এই কাদা-
ছোঁড়াছুঁড়িতে দু পক্ষের সমর্থক মিডিয়াগুলোও অংশ নিচ্ছে! ফলে দেশটি সংবাদের জগতের প্রতিও
আস্থা হারাচ্ছেন মার্কিন জনগণ!