সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির স্বপ্নগুলো বাস্তব হোক নতুন বছরে। অন্ধকার ফিকে হোক ক্রমশ, অনাবিল আলোয় ভরে উঠুক বংলাদেশ। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, নেতির জয় কখনও হয়নি। বাঙালি জাতি খাদের কিনার থেকেও বার বার ফিরে এসেছে। তাই চোখে স্বপ্নটা থাক বর্তমান। অন্ধকার কাটিয়ে আলো আনার দায়িত্বটা সকলকেই নিতে হবে। সকলকে নতুন বছরের হার্দিক শুভেচ্ছা। নতুন বছর প্রত্যেকের ভাল কাটুক।
ভাল থাকাটা, ভাল হওয়াটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটা কালো অন্ধকার মেঘ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন একটা বছর সঙ্গে নিয়ে হাজির হবে বৈশাখের সকালে, ১৪২৮ পুরো সময়টা সেই সকালের মতোই ঝকঝকে হয়ে থাকুক, উজ্জ্বল হয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাক, বৈশাখে থাক এই আশাবাদ।
গত বছরের আবর্জনা দূর হওয়ার প্রত্যাশায়, সর্ব অঙ্গে মলীনতা মেখে আমরা নতুন বছরকে আবাহন করেছি। অতীত ভয় দেখায়। আতঙ্ক তৈরি করে। অন্ধকার বাড়িয়ে দেয়। করোনার থাবায় ১৪২৭ এর পয়লা বৈশাখ জুড়ে ছিল না উৎসব। বারো মাসে তালিকায় বাংলা বছরের প্রথম দিনটা নিজস্ব মহিমায় স্থান করে নিতে না পারলেও হৃদয়ের বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ। আবার বৈশাখ, দেশ জুড়ে নতুন জামা, দোকানে দোকানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ, উষ্ণ আন্তরিকতা ফিওে আসুক নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন যার স্বাদ বছর ভরে চলবে।
দিন বদলের পালায় বাংলা বছর তার গরিমা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। বাংলা বছর এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দিন মাত্র। নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। এ সব আক্ষেপ এত দিনে বাঙালির গা-সওয়া। কিন্তু হিসেবের নতুন বছরের খাতা খোলার লগ্নে হাতে কী রইল, তা ভুললে চলে না।
একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, কিছু দিন ধরে চার দিকে যে সব কা- ঘটে চলেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ছন্দ যে ভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং খাচ্ছে, যেভাবে ভাবনায় দীর্ঘ ছায়া ফেলছে ভয় এবং অবিশ্বাস, তাতে বাঙালি জাতির গৌরবের ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়টার প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সর্বত্র। বৈশাখেই নিজেদের ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের ঢাক পেটানোর দিনে আত্মসমীক্ষা এবং নিজের বিচার জরুরি।
পরিবর্তন এল, তার সঙ্গী আছে কিছু স্বপ্নও। লোক বিশ্বাস, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু এগারো বছর পেরিয়ে আবার চার পাশে কেমন এক অস্থিরতার বাতাবরণ। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তবে কেন?
সব কিছুতেই রাজনীতি এবং চক্রান্ত দেখতে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বেশ পটু হয়ে উঠছে। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করলেই তাতে কেউ কেউ দ্রুত চক্রান্তের গন্ধ টের পেয়ে যান। যারা শাসকের আসনে থাকেন, গন্ধবিচারের ক্ষমতাও আবার তাঁদেরই বেশি থাকে! নিজেদের কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের জন্য ভুল স্বীকার নেই। দল-মত-রং নির্বিশেষে এটা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ। সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।
অসহিষ্ণুতা? কেন এত হিংসা? বাতাসে কেন এত বিষ? আমরা কি পরস্পরের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছি? যাঁরা রাজনৈতিক কান্ডারি, আস্থা ও বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি করার বড় দায়িত্ব কিন্তু তাঁদেরই থাকে। কারণ তাঁরা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে দায়বদ্ধ। সেখানে শিথিলতা ঘটলে বিষয়টি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পর্যবসিত হয়। শরীর শক্তপোক্ত না হলে যেমন রোগ সহজে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়, ব্যাপারটি তেমনই চলমান।
এগারো বছরে অনেকটাই বদলেছে বাংলাদেশের চেহারা। শহর থেকে গ্রাম, সেই বদলের মুখচ্ছবি স্পষ্ট। একের পর এক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষ সরাসরি লাভবান। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আত্মিক ‘উন্নয়ন’ হয়তো প্রকৃত অর্থেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তবু কেন মানুষের এত অবিশ্বাস বাড়ছে রাজনীতিকদের ওপর? শিক্ষিত সমাজের একটু সদিচ্ছা, সততা, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রতিস্পর্ধাহীন মানসিকতা দরকার। ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠার উদারতা। মানুষের গণতন্ত্রে শিক্ষিত সমাজ বড় গুরুত্বপূর্ণ। এতটুকু উদারতা বাঙালি শিক্ষিত সমাজ দেখাতে বদ্ধপরিকর হতে পারলে বাঙালির নববর্ষ সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে উঠবে। যার গর্বিত ভাগীদার হবে সমগ্র জাতি।
গোটা বছর ধরে অনেক রকম সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবাত্মার সাংঘাতিক অসম্মান ঘটিয়ে বাংলার নানা প্রান্তে মাথা তুলেছে হিংসার বিষ। অশান্ত, উত্তপ্ত, রক্তাক্ত হয়ে রইল বাংলার মাটি। গণতন্ত্র নিয়ে রাজনীতিকদের নির্লজ্জ ও বেনজির আঘাত এবং মিথ্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। আরও নানা নেতি হানা দিয়েছে এবং হানা দিতে চাচ্ছে নানা রন্ধ্র পথে।
ইতিবাচক কিছু ঘটেনি গত একটা বছরে, এ কথা বলা যায় না যদিও প্রাণঘাতী করোনার হানায় নাকাল পুরো বিশ্ব। জীবন তার আপন ছন্দ, রূপ, রং, স্পর্শ, আঘ্রাণ নিয়ে নিরন্তর সামনের দিকে নিয়ে চলেছে আমাদের প্রত্যেককেই। শত-সহ¯্র নেতির সাক্ষী হতে হলেও সেই নিরন্তর অগ্রগতিতেই ইতিবাচকতার সবচেয়ে আনন্দ। বছরের শেষ সকালে পৌঁছে খেরো খাতার শেষ পাতায় অগ্রগতির যোগফল থাক, সে যোগফলকে নতুন খাতায় তুলে নেয়ার তোড়জোড় থাকুক দেশবাসীর মধ্যে। নেতির হিসেব ওই শেষ পাতাতেই শেষ হয়ে যাক। বয়ে যেন না নিতে হয় পরের নতুন খাতায়। অঙ্গীকারটা এমনই হোক।
দুটো ১৪২৭-১৪২৮ এর মধ্যে অনেকখানি ব্যবধান সঞ্চারিত হোক পৃথিবীর একটা মাত্র আবর্তনকে সাক্ষী রেখে, ১৪২৮-এর শুরুতে অনেক কিছু নতুন আলোয় ধরা দিক, এমনই আকুতি সময়ের চোখে। নতুন বছর বার বারই প্রতীকী তারুণ্য নিয়ে ধরা দেয়। কার্যক্ষেত্রে এ যুগে ইংরেজি নতুন বছরটাই আসল নতুন বছরের তকমা আদায় করে নিয়েছে। বাংলা নববর্ষ কার্যত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। তবু পয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালি মননে স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ, নির্মল অস্তিত্ব নিয়ে ধরা দেয় আজও। অতএব, পয়লা বৈশাখ আজও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ধিক্ষণ, যে সন্ধিক্ষণে জীবনের শপথগুলোকে ঝালিয়ে নেয়া যায় নিষ্কলুষ। অনেক কিছু হয়তো ভুল হয়ে গিয়েছে, অনেক কিছু হয়তো অনাকাক্সিক্ষত পথে এগিয়েছে, গোলমাল হয়ে গিয়েছে হয়তো অনেক রকম হিসেব গোটা একটা বছর ধরে। সেই সমস্ত ভেস্তে যাওয়া হিসেবের খাতা সপাটে বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে ফেলার অবকাশ এবারেও নিয়ে এসেছে পয়লা বৈশাখ।