নতুন আলোয় উদ্ভাসিত মার্চ ২০২১!

শেখ উল্লাস ॥ মার্চ ১৯৭১ থেকে মার্চ ২০২১। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। ৫০ বছর আগের মার্চ মাস আর আজকের মার্চ মাসের প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই এক নয়। এক হওয়ার কোনো কারণও নেই। পরিবর্তন, বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়েই তো সময় এগিয়ে যায়। এই বাস্তবতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যারা চলতে পারে না তারাই হারিয়ে যায়। তবে মিথ্যাচার, মুনাফেকির আশ্রয় নিয়ে যারা টিকে থাকে, সমাজ ও মানুষের কল্যাণে এমন কি নিজেদের কল্যাণেও কিছুই করতে পারে না। সমাজে শুধু অশান্তি, বৈষম্য, অনাচার ও মিথ্যাচারের ধুম্রজালই তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ আবার শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিকও বনে যেতে পারে। কিন্তু টিকিয়ে রাখতে পারে না। ১৯৭১-এ বাংলার মানুষের বাস্তবতা ও চাওয়া-আকাঙ্খা যারা বুঝতে চায়নি, যারা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধ করেছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজাকার হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছিল, কোটি মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছিল তাদের কথাও ঘৃণাভরে স্মরণ করতে হয় এই মার্চে। ‘সত্য যে বড় কঠিন’!

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছরের পথ-পরিক্রমায় কত পিচ্ছিল পথই না পাড়ি দিতে হয়েছে লাখো শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা এই দেশটিকে। তবে সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে এসে বাংলাদেশ যে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত সে কথা অনস্বীকার্য। ২০২১’এর মার্চে প্রবেশের ঠিক তিন দিন আগে স্বল্পোন্নত  দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে পাঁচ দিন বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করে। সিডিপির এলডিসি-সংক্রান্ত উপ গ্রুপের প্রধান টেফেরি টেসফাসো এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। এর পরদিন গণভবন থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন ‘১২ বছর ধরে সরকার পরিচালনায় নিরন্তর পরিশ্রম এবং পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে এই অর্জন’। তিনি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার স্বীকৃতি তরুণ প্রজন্মকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেছেন, এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সরকার শুধু নীতি-সহায়তার মাধ্যমে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

উন্নয়নের চলমান গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে-এমন আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটল, যখন আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছি, আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।’ এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।’

আজ থেকে ৫০ বছর আগের মার্চ মাসের ধারাবাহিকতার ফসলই তো আজকের বাংলাদেশ। কেমন ছিল সেদিনের মার্চ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, ইতিহাসের সন্ধান করতে গেলে দেখা যায় যে, ১৯৭০’এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এক বেতার ভাষণে পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত  ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে স্বত:স্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ওইদিনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো’ ইত্যাদি শ্লোগানে ঢাকা আন্দোলিত ও বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। সারা বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) তখন উত্তাল। ঢাকার ফার্মগেটে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণও কারফিউ জারি করা হয়। পূর্বাণী হোটেলে সেদিন আওয়ামী লীগের এমএনএ-এমপিএদের বৈঠক চলছিল। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত করা খুবই দুঃখজনক। …আওয়ামী লীগের আপাত কর্মসূচি হচ্ছে, ১ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের আয়োজিত জনসভায় চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ ২ মার্চ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্রসভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকায় কারফিউ ভঙ্গ করে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বহু হতাহত হয়। ওই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী বলবেন সেই দিকে সবার দৃষ্টি। অবশেষে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যা হয়ে গেল বাঙালি জাতির অমর ইতিহাস। কবির ভাষায়, ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’।

সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ ৭ই মার্চ দিবসটিকে বাংলার ঘরে পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করে আসছে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এ দিবসটিকে সরকারি মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি এদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে সম্প্রতি। বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে আরও আগেই। ৭ই মার্চকে এখন অস্বীকার করতে পারছে না বিরোধী দল-বিএনপিও, যে দলের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে দলীয়ভাবে ৭ই মার্চ পালনের ঘোষণা দিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। দলের অন্যতম নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘৭ই মার্চ অবশ্যই ইতিহাস, পার্ট অব দ্য হিস্টরি। এদিন যে ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন তার সম্মান ও মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে।’

সব মিলিয়ে ২০২১ সালের মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে আবারও এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত। কারণ, ৭ই মার্চকে সবাই স্বীকার করে নিলে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যে দোলাচল, যে দ্বন্দ্ব ও অপরাজনীতি সমাজ-পরিবেশকে বিষিয়ে রেখেছে তা দূর হবে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজেও কোনোদিন বলেন নাই, বলার সাহসও তার ছিল না, তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে দুপুর বেলায় চট্টগ্রামের কালুর ঘাটে স্বাধীনতাসংগ্রামী শব্দসৈনিকদের তৈরি করা বেতার কেন্দ্র (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন মাত্র। জিয়াউর রহমানকে ওই বেতার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও সশ্রস্ত্র যুদ্ধে যাওয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতাসংগ্রামীরাই। ঢাকায় ২৫ মার্চে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার পর এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যে যেখানে যেভাবে পেরেছে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ৭ মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা, ‘আমি যদি হুকুম দেয়ার নাও পারি..তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশনা মানতে ভুল করেনি বাঙালি জাতি। যে যেখানে পেরেছে সেভাবেই প্রতিরোধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটিই ছিল সকল যুদ্ধ ও শক্তির প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অনাহুত বিতর্কের অবসান হলে জাতির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথ-পরিক্রমা আরও মসৃণ হবে বলে অভিমত সচেতন মহলের।

তবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপনকে কেন্দ্র করে তৈরি আলোর মধ্যেই যে বিষয়টি অন্ধকার সৃষ্টি করে চলছে সেটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগে জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতির সর্বস্তরে তোষামদি, দালালিসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি সমাজকে কলুষিত করছে। দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত নিবেদিতপ্রাণ, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না যার প্রভাব পড়ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাসহ সকল কর্মকা-ে। সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে এ সমস্যাটি যতটুকু, তার চেয়েও বেশি প্রকট বিরোধী দল বিএনপিতে। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র তথা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনও শক্তিশালী ও বিকশিত হতে পারে না। চলমান পৌরসভা ও আসন্ন ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রস্তুতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু  এই মার্চ শুরুর আগের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের বাঁধা ও লাঠিপেঠার সম্মুখীন হয়ে বিএনপি ও ছাত্রদল ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তাতে সরকারি দলের একচ্ছত্রতা আরও শক্তিশালী হবে বলেই আশঙ্কা জানান দিয়েছে। এই একচ্ছত্রতা দেশের জন্য কতটুকু মঙ্গল ও অমঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে সেটাই এখন সচেতন মহলের চিন্তার বিষয়।