মারুফ রসুল।। আইন তৈরি ও তার প্রয়োগের ওপর রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ভর করে। বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করার যে দুঃশাসন নীতি সরকার গ্রহণ করেছে তা থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনিক চরিত্র বোঝা যায়। একটি নিপীড়নমূলক আইন কেবল তৈরি নয়, তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের বদ-উদ্দেশ্য বোঝা যায়। লেখক মোশতাক আহমেদ, কার্টুনশিল্পী আহমেদ কবির কিশোর বা এ যাবৎকালে এই নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারকৃতদের তালিকা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এটা করাই হয়েছে তথাকথিত ‘সরকারবিরোধী’ ও ‘তার তল্পিবাহকবিরোধী’ মন্তব্য দমনের জন্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের কোন আইনে আছে যে, সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না? সরকার ও তার প্রশাসনের লোকজন দুর্নীতি করবে, লুটপাট করবে, চুরি করবে, ক্ষমতার অপব্যবহার করবে আর জনগণ তার বিরোধিতা করবে না? সমালোচনা করবে না?
এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দমনমূলক ধারাগুলো নিয়ে বহুদিন ধরেই সচেতন নাগরিকরা প্রতিবাদ করে আসছেন। এই আইনের খড়গ সিংহভাগ সময়েই লেখক-প্রকাশক-বাউলশিল্পী-ব্লগারসহ সচেতন নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। বিনা বিচারে দিনের পর দিন কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। লেখক মোশতাক আহমেদকে তো হত্যাই করা হলো। হত্যা এ কারণেই যে, কারা-অভ্যন্তরে ঘটা প্রতিটি মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের। লেখক মোশতাক আহমেদ ও কার্টুনশিল্পী কিশোরের জন্য জামিন আবেদন করা হলেও আদালত তাদের জামিন দেয়নি। মেনে নিলাম জামিন দেয়া বা না-দেয়ার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত বিষয়ক আলোচনা আইনজীবীরাই ভালো বুঝবেন; কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন -অসুস্থ মোশতাক আহমেদের চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা কি কারা কর্তৃপক্ষ করেছিলো?
তারা যে সেটা করেনি, মোশতাক আহমেদের মৃত্যু এবং কিশোরের শারীরিক অবস্থাই তার প্রমাণ। অথচ এই রাষ্ট্র দিনের পর দিন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেছে। বহু শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিনা কারণেই হাসপাতালে ‘অবসর’ কাটায় এই খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখি। এই কিছুদিন আগেও হলমার্ক কেলেঙ্কারির আসামী কারাগারে আইনবহির্ভূত সুবিধা নিয়েছে কারা কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই। সিকদার গ্রুপের সন্ত্রাসীরা অপরাধ করে পালিয়ে যায়, আবার জামিন হবে জেনেই বিমানবন্দরে ধরা দেয়। হাজী সেলিমের ছেলেরও জামিন হয়। অপরাধ বিবেচনায় নয়, এসবই হয় ক্ষমতার জোরে, অর্থের জোরে। এ কারণেই মোশতাক আহমেদকে জেলখানাতেই মরতে হয়, কার্টুনশিল্পী কিশোরের জামিন হয় না, মাসের পর মাস বিনা বিচারে জেলে আটক থাকতে হয় বাউলশিল্পীদের, মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি খেলার মাঠের দাবি জানালে জেলে যেতে হয় চুয়াডাঙ্গার মানিক খানকে। কারণ তাঁদের ক্ষমতার জোরও নাই, অর্থের জোরও নাই- তাঁরা শিল্পী-লেখক-প্রকাশক-ব্লগার বা সাধারণ সচেতন নাগরিক। এদেশে ব্যাংক লুটেরা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা, মন্ত্রী-এমপি বা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ির সন্তানদের ক্ষেত্রে আইন খুব সরলরেখায় চলে। ধর্মব্যবসায়িদের ক্ষেত্রে আইন তো প্রায় চোখেই দেখে না। দেশে কয়টি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিচার হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব দেবার সময় রাষ্ট্রের লজ্জা লাগবে না?
দমনমূলক আইন প্রণয়ন ও উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে নাগরিকদের গলা টিপে, কণ্ঠরোধ করে কিংবা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তোষণ করে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো সরকার তার ক্ষমতাকে সুসংহত করতে পারেনি। যে গলাটেপা আইন আর প্রশাসনকে এখন ব্যবহার করছেন, তারাই একদিন আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে সেটা আপনারাও জানেন, আমরাও জানি।