সত্যদর্শী ॥ কোন কিছুর সত্য জানতে হলে পুরো প্রেক্ষাপটকে ধরেই এগুতে হয়। মহান সাধক আনোয়ারুল হক এঁর অমৃত কথা ‘দর্শন- উপলব্ধিতে হয় সত্য, অন্যের কথায় নয়’ ।
জগৎ-সংসারে কোন কিছুই অযাচিত নয়, হঠাৎ ঘটে না। কারণের কারণ থাকে। ঘটনার নেপথ্যে থাকে ঘটনার উপযোগিতা। একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে আমরা শব্দ শুনতে পাই, বোমাটির শক্তি, ক্ষয়-ক্ষতি, বিস্ফোরণের কারণ জানতে পারি। কিন্তু অনুসন্ধানে ধরা পরে পুরো বিষয়টির সত্য। যা আমাদেরকে নিয়ে যায় সেই সত্যের কাছে, যে সত্যের নেপথ্যে একটি গোষ্ঠীগত স্বার্থ, সক্ষমতা, চরিত্র লাভ কিংবা সুদূরপ্রসারী কোন প্রাপ্তি যোগ রয়েছে। আমরা আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, অশান্ত অস্থির মনোভাবের কারণে কোন কিছুর গভীরে প্রবেশ করতে পারি না বলে হুজুগ, গুজব, বিভ্রান্তি, অতি কাল্পনিক, গাল গল্পে মশগুল হয়ে পড়ি।
সত্য চোখের সামনে এসে আবার মিলিয়ে যায়। লালন ফকির ভণিতায় এসে বারবার নিজেকে ভেড়ো স্বভাবের সাথে তুলনা করে প্রকারান্তরে বাঙালি চরিত্রের গভীর ক্ষত দিকটিই তুলে ধরেছেন।
সম্প্রতি আলজাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত কারিগরি জারিজুরিটি নিয়েও সেই প্রবণতা দেখা গেল। একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা যেতে পারে। ভারতবর্ষে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কত মার্কে পাশ নির্ধারিত হবে সেটি নির্ধারণ করার জন্য ব্রিটিশরা দুঃখজনক একটি ব্যরোমিটারের সাহায্য নিয়েছিলেন। সেটা হলো ব্রিটিশদের পাশ ছিল ৬৫ মার্কে। বাঙালির মেধা অর্ধেক। ফলে তার অর্ধেক ৩২.৫০ পাশ মার্ক!!! বাংলাদেশ বহু পথ এগিয়ে গেলেও এখনো বিশ্বের বহু দেশ হেয়ালীর চোখে দেখতে চায়। আর ইসলামের ধব্জাধারী আরবদের কোন কোন দেশের শাসকরা আমাদেরকে তো মুসলিম হিসেবেই গণ্য করে না।
সত্য ভাসমান পানা নয়। সত্য কোন চমক নয়। সত্য সাইন্স ফিকশন কিংবা কতিপয় লোকের দক্ষ কারিগরি নয়। কারো মুখের কথায়, জোড়াতালি দিয়ে সত্যের নামে নাটক মুভি বানানো যায় তাতে সত্য হয়ে যায় না।
এ জন্য ভেড়ো স্বভাবের লোকজন কান নিয়েছে চিলে শুনেই ছুটতে থাকে। কোনদিন সত্য জানতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরায় প্রচারিত ডকু ড্রামার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর স্বভাব হারানো গুজবধারী লোকের দৌঁড়ঝাপ নতুন করে সেই পুরোনো কথাটিই মনে করিয়ে দিল। এক শ্রেণীর বাঙালি এখনো কল্পনা প্রবন, কখনো কখনো আত্মবিস্মৃত। এই সত্য আমাদেরকে মনে রাখতে হবে দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের দেশের স্বাধীনতা কারো দানে পাওয়া নয়। আধিপত্যবাদীদের মুখে ছাই কালি মেরেই চরম ত্যাগের মহিমামন্ডিত এ দেশের স্বাধীনতা।
পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম এই যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। ২ লক্ষ নারী মুক্তি যোদ্ধা এবং ভারতের বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে অকাল মৃত্যুর স্বীকার ৭/৮ লক্ষ নব জাতকের মৃত্যুকেও যুক্ত করতে হবে স্বাধীনতার ইতিহাসে।
৭০ এর নির্বাচন যখন স্পষ্টতই স্বাধিকার স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছিল, তখন ২৮% দেশ বিরোধী লোক স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এরাই আবার ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ী চিনিয়ে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ করেছে, পাকিস্তানি সেনাদের রাস্তা ঘাট চিনিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীন দেশে আজও সেই কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেনি। বরং পদে পদে বাধা দিয়েছে। ৭১ সালের পরাজয়ের প্রথম প্রতিশোধ নিয়েছে ৭৫ এর ১৫ অগাষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। লক্ষণীয় বিষয় তথাকথিত আরব বিশ্ব দীর্ঘদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ তারা এ দেশের কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে মানুষ কিংবা মুসলিম বলেই মনে করেনি। ৭১ এর যুদ্ধ কেই বরং তারা ইসলাম ভার্সেস বাংলাদেশ হিসেবে দেখেছে। ধর্মযুদ্ধ হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে ঈমানী আকীদা রক্ষা ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রশ্নে। ফলে সে সময় মুসলিম দেশগুলোর বহু সংবাদমাধ্যমগুলোও এটিকে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ হিসেবে বর্ননা করেছে। বর্তমানের আলজাজিরা কিংবা খোদ দেশটির আমির ওমরাহরাও একই চরিত্র প্রদর্শন করেছে। সেই যে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে আজও বাংলাদেশ বের হতে পারেনি। ফলে আবারো সেই পুরোনো শকুন খামচে ধরেছে জাতির পতাকা। বিদেশী একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে ব্যবহার করে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের জানান দিলো ঘাতকরা। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টিকে গুরুত্বহীন মনে করা হলেও কোনভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিবন্ধ করলে প্রচারিত ডকু মুভিটি নির্মানের উদ্দেশ্য ধরা পড়বে।
সম্পুর্ন ডকুফিকশনটিতে নজর দিলে ঘাতকচক্র ও এদের লক্ষ্য অনুমান করা কঠিন নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম ধ্বংসের পরিস্কার চিত্রটি যেমন ফুটে উঠে। যাতে করে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হেয় প্রতিপন্ন হয়, সেনা অভ্যন্তরে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী হয় এবং শান্তি মিশনে না নেয়া হয় বাংলাদেশ থেকে। তেমনি এক ঢিলে সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপতি, পুলিশ বিভাগকেও জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ডকুড্রামাটির এমন একটি বাজে নাম দেয়া হয়েছে, যা বিরাট আঘাত। ইসরায়েল প্রসঙ্গ টেনে এনে মুসলিম বিশ্বে দেশের ইমেজ নষ্ট করার একটা তৎপরতা, দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উগ্রতাকেও উসকে দেয়ার হীন উদ্দেশ্য ধরা পড়ে।
প্রথমত সেনা প্রধানের নৈতিক ভিত্তিকে যেমন নাড়াতে চেয়েছে। একই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে একটি দুষ্ট বলয়কে প্রমানের খোঁড়া সব অজুহাত দাঁড় করাতে চেয়েছে। বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছে বাংলাদেশ একটি মাফিয়া এস্টেট এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব তেমন একটি বলয় দেশে বিদেশে তৎপর। সরকার প্রধানের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নেই।
পুরো ডকু-ফিকশন কিংবা ফ্লিমটি পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায় প্রথমত তারা সেনা প্রধানকে আঘাত করতে চেয়েছে। যেহেতু সেটি করতে হলে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ব্যক্তিতে জড়াতে হয়। ফলে পুরোনো একটি গল্পের অবতারণা করা হয়েছে মোহাম্মদপুরের এক সময়ের একটি ঘটনাকে সামনে এনে। অথচ ৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে সন্ত্রাস অস্ত্র সবই আমদানী করেছে খোদ তৎকালীন শাসকরাই। রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করতে সবই করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান নিজেই বলেছেন- ‘মানি ইজ নো প্রবলেম/ আমি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করে দেবো’। তখন তো বেঁচে থাকতেও আত্মগোপন করতে হয়েছে বহুজনকে। আর মহল্লায় টিকে থাকতে প্রতিরোধ করে জীবন হারাতে হয়েছে অনেককে।
পরিচালক ফিল্মী কায়দায় এনিমেশনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে একটি ঘটনাকে। অথচ ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন ছিল, রাজনীতির নামে কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা সহ হাজার হাজার আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, সেসবের কোন তথ্য নেই এখানে। নেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। মনে হচ্ছে উড়ে আসা জুড়ে বসেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সাল থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত কি কি করা হয়েছে, চলেছে তার কোন কথা এখানে নেই। ৯১ সাল থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ভয়াবহ সংখ্যালঘু উচ্ছেদ নির্যাতনের কোন তথ্য নেই।
বরং আরো একটি গভীর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, সেটি হলো ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড যেহেতু কিছু সেনা সদস্য সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল, সেটির প্রতিশোধ নিতেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী সহ বিজিবিকে কৌশলে ধ্বংস করছেন!! ভয়াবহ একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি নিয়ে যাচ্ছেন। এমনটাই বলা হয়েছে আল জাজিরা প্রচারিত এই ডকুফিল্মে। ডকুফিকশনটিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিকে আঘাত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্মিত এই ডকুফিল্মটি রীতিমতো ভয়াবহ কাজ। দেশ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। বিপুল ব্যায়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এটি নির্মান করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কোন শক্তিশালী মহলের অর্থায়ন ও নিবিড় তদারকিতেই কেবল এমনটি হতে পারে।
প্রচারিত প্রতিবেদনটিতে দেখানো বহু তথ্যই শেষ পর্যন্ত তেমন কোন কিছুই প্রমান করেনা। যেমন হোটেল কিনতে চাওয়া, ম্যালেয়েশিয়ায় নজরদারি, একজন মাতালের চাপাবাজি, ড্রোন ব্যবহার করে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, ইসরাইলের সাথে চুক্তি কিংবা ডিএইচএলে ডকুমেন্টস পাঠানো। তবে এটি প্রমান করে কাজটি বড় পরিকল্পনার অংশ। সরকার ও দেশপ্রেমিক জনগণের জন্যে কিছু শিক্ষণীয়। আমাদের বুঝতে হবে ষড়যন্ত্রের শেকড় কতটা গভীরে, ডালপালা কতটা বিস্তৃত।
আমরা হয়তো সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনীতির নামে লোভের আগুনে পোড়া তথাকথিত বিপ্লবী রাজনীতি, ফ্রিডম পার্টির দৌরাত্ম্য, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের ময়নাতদন্তই এখনো সম্পন্ন করতে পারিনি। ১০ ট্রাক অস্ত্র কারা এনেছিল আমরা কি তা জানি আজও ? এক সময় সীমান্তসহ খোদ রাজধানীতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আনাগোনার খবর ভুলে গেছি? শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্ডব, একজন যুদ্ধপরাধীকে চাঁদে দেখার গুজবে পিটিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা। মানবতাবিরোধী দের বিচার বন্ধের নামে তান্ডব, রাজধানীর সড়কে সড়কে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। এসবই কি একই সূত্রে গাঁথা?
কথায় আছে শকুন যতই উপরে উঠুক চোখ তার ভাগাড়ের দিকেই থাকে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি ’৭১, ৫২’র চেতনা। চেতনা হয়তো কফিন বন্দি। আবার সক্রিয় সেই একই ঘাতকেরা। এখন ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে। যেহেতু এদের বিদেশী বন্ধু রয়েছে। দেশে আছে ইন্টারেস্ট গ্রুপ। এসব গ্রুপের রয়েছে পাহাড় সমান টাকা। সেসব টাকায় পোষা পাহারাদার। মুখোশ পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরে মহল্লায় অফিসপাড়ায়।
ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো পথ হারিয়ে ফেলেছে। সীমাহীন ভ্রান্ত রাজনীতি সহজ করে তুলেছে ঘাতকদের কাজকে। তথাকথিত উন্নয়নের রাজনীতির চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশ। গালগল্প তোষামোদের রাজনীতি। ফলে কর্ম ফল হয়ে দেখা দিচ্ছে। জিডিপির হিসাব আছে কালচারাল জিডিপির হিসাব কারো জানা নেই। বরং চরিত্রহীনদের মোকাবেলা করতে যেয়ে শাসকদলও সেই স্রোতে কম বেশি ভেসে চলেছে। পর্যবেক্ষণ বলছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সরকারী দলের প্রায় সব পর্যায়ের নেতা কর্মী। কেবলই উদভ্রান্তের মতো দৌঁড়ঝাপ। স্বজন প্রীতি, পকেট নীতি, দালাল তৈরীই যেন রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে যেমন অরক্ষিত করে তুলেছিল নিজেরাই। তেমনি বর্তমান নেতৃত্ব শেখ হাসিনাকেই বিপদাপন্ন করে তুলছেন। মুজিব বর্ষ উদযাপনের নামেও অপ্রয়োজনীয় অদরকারী লোকদেখানো কর্মকান্ডের মহড়া চলছে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে। পদে পদে বর্নচোরা মুনাফেকরা ফাঁদ পেতেছে।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজজামান বলেছিলেন – ‘আওয়ামীলীগ আমাদের সমর্থন চায়, পরামর্শ চায় না’। তবু বলবো উন্নয়নের রাজনীতি নয়, দরকার রাজনীতির উন্নয়ন। একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক জাগরণ। যা উপেক্ষা করা হয়েছে। নতুন ভাবনার রাজনীতি নেই। রাজনীতিতে সৃষ্টিশীল ভাবনা অনুপস্থিত। জাতি চেতনার শক্তির উপর দাঁড়িয়েই হাসতে হয় বিজয়ের হাসি। যা বেমালুম ভুলে বসে আছে রাজনীতিকরা।